গত ৯ আগস্ট, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল, সংক্ষেপে যাকে বলা হয় আইপিসিসি (IPCC), একটি উদ্বেগজনক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আইপিসিসি হলো ১৯৫ টি দেশের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সাইন্টিফিক প্যানেল। পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন মনিটর করার জন্য ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘের আবহাওয়া সংস্থা এবং পরিবেশ কার্যক্রমের যৌথ উদ্যোগে আইপিসিসি গঠন করা হয়েছে। এর কাজ হলো, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্য এবং উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ ব্যাপারে নীতি নির্ধারণ করার জন্য জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোকে পরামর্শ দেওয়া।
আমরা জানি, বায়ুমন্ডলে মানুষের সৃষ্ট বিভিন্ন গ্রিনহাউস গ্যাস, যেমন কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি গ্যাসের প্রভাবে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর ফলে বৈশ্বিক জলবায়ুও ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। এর ক্ষতিকর প্রভাব পৃথিবীর সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে। এর ফলে বিভিন্ন স্থানে দাবানল, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়,খরা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ক্রমে বেড়েই চলেছে। ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়াতে নজিরবিহীন দাবানল স্বচক্ষে দেখার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিলো। এ বছর ভয়ঙ্কর দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে গ্রিস, ইতালি, তুরস্ক সহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, অরেগণ সহ পশ্চিম উপকূলের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যেও এ বছর ভয়াবহ দাবানল হয়েছে। ক্যানাডায় বয়ে গেছে ভয়াবহ তাপদাহ। অন্যদিকে নজিরবিহীন বন্যায় ডুবে গিয়েছে জার্মানির বেশ কিছু অঞ্চল। ভয়াবহ বন্যা হয়েছে ভারত এবং চীন দেশে। ঘূর্ণিঝড় এবং খরার প্রকোপও দিন দিন বাড়ছে।
এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনজীবন হয়ে উঠছে বিপর্যস্ত। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব প্রতিবছরই দৃশ্যমান হচ্ছে।
আইপিসিসির সর্বশেষ প্রতিবেদনটি পৃথিবীর জন্য একটি ভয়াবহ অশনি সংকেত। এতে বলা হয়েছে, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা এখন খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বায়ুমন্ডলে গ্রীন হাউস গ্যাস, বিশেষত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বৃদ্ধির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে না কমানো গেলে, আগামী এক দশকের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এর ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে জলবায়ুর উপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে। গ্রীষ্মকালে তাপদাহ আরো অনেক বেড়ে যাবে এবং শীতকালের পরিধি কমে যাবে। ঋতুচক্রের উপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসে পৌঁছে গেলে, জনজীবন হয়ে উঠবে বিপর্যস্ত। জনস্বাস্থ্য হয়ে উঠবে বিপন্ন। কৃষির উপরেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে। মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা তখন হয়ে উঠবে হুমকির সম্মুখীন।
পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে, বৃষ্টিপাতের বিন্যাস পরিবর্তিত হয়ে যাবে। এর ফলে কোন কোন অঞ্চল প্রতিবছর ভয়াবহ বন্যায় ডুবে যাবে আবার কোন কোন অঞ্চল বৃষ্টিপাতের অভাবে মরুভূমিতে পরিণত হবে। আরো ভয়াবহ ব্যাপার হলো, মেরু অঞ্চলে শত শত বছরের জমে থাকা বরফ গলে যাওয়ার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে ভবিষ্যতে সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত অনেক দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে যাবে। এসব উপদ্রুত দেশের মধ্যে আমাদের বাংলাদেশও রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানো না গেলে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে যাবে।
শুধু আমাদের দেশই নয়, বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে আমাদের সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সুন্দর গ্রহটি বসবাসের জন্য অযোগ্য হয়ে যেতে পারে। মোদ্দা কথা হলো, মানুষের অবিমৃষ্যকারী কর্মকাণ্ডের জন্য পৃথিবীর ভবিষ্যৎ আজ হুমকির সম্মুখীন। এই অবস্থা অবশ্য একদিনে সৃষ্টি হয়নি। শিল্পোন্নত দেশগুলোর ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে গত কয়েকশো বছরে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে বিভিন্ন গ্রিন হাউস গ্যাস, বিশেষত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান শতাব্দীতে এসে জলবায়ুর উপর এর নেতিবাচক প্রভাব ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। এই ক্রমবর্ধমান অবস্থা চলতে থাকলে এর ফলাফল যে খুবই মারাত্মক হবে সেটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কি? আসলে এ ব্যাপারে অনেক আগেই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমরা অন্তিম সময়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। তবুও বিজ্ঞানীরা বলছেন, এখনো সময় আছে আমাদের কার্বন ফুট-প্রিন্ট কমানোর। সেই লক্ষ্যে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল পর্যায়ে আমাদের গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে হবে। সৌর বিদ্যুৎ, উইন্ড টারবাইন, জলবিদ্যুৎ, জিও থার্মাল ইত্যাদি বিভিন্ন নবায়নযোগ্য শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর আমাদের নির্ভরশীলতা একদম কমিয়ে ফেলতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কয়লা, পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থ এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার অনেক কমিয়ে আনতে হবে। পেট্রোল এবং ডিজেল চালিত গাড়ির পরিবর্তে বিদ্যুৎ চালিত গাড়ির ব্যবহার বাড়াতে হবে।এতে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ অনেক কমে যাবে। বাসার আশপাশে এবং পতিত জমিতে প্রচুর গাছপালা লাগাতে হবে। প্রাকৃতিক বনভূমি গুলোকে রক্ষা করতে হবে। বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে গাছপালার বিশাল ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া সম্পদের অপচয় কমিয়ে রিসাইকেল বাড়াতে হবে। সেই সাথে আমাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। বিশেষত খাদ্যের জন্য গবাদি পশুর উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে। কৃষিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমাতে হবে। মানুষের মধ্যে এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এ ব্যাপারে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের এই সুন্দর গ্রহটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেলে আমাদের কিন্তু আর কোন বাসভূমি নেই। সুতরাং আমাদের সবাইকেই এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এ ব্যাপারে পৃথিবীর নীতিনির্ধারক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
আশার কথা হলো, বর্তমানে বেশ কিছু নতুন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে যা দিয়ে বায়ুমন্ডলে ক্ষতিকর গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। এ ব্যাপারে নতুন কিছু পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা চলছে। এই গবেষণার মূল লক্ষ্য হচ্ছে, বায়ুমন্ডলে বিরাজমান অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসকে অণুজীব নির্ভর জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাটির অভ্যন্তরে স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত করা। আশা করা যাচ্ছে, এর ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে এবং এর পাশাপাশি মাটির উর্বরতাও বৃদ্ধি পাবে। এই লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন। এর পাশাপাশি বায়ুমন্ডলে মিথেন গ্যাসের পরিমাণ কমিয়ে আনার ব্যাপারেও জোর গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। আসল কথা হলো, বায়ুমন্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ কমিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। এটা না করা গেলে, আমাদের জন্য এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে, এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর "ছাড়পত্র" কবিতায় লিখেছিলেন:
"প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।"
কবি সুকান্তের মত আজ এটা হোক আমাদের সবার অঙ্গীকার।
আশা করছি আইপিসিসির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনটি এ ব্যাপারে সঠিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে একটি দিক নির্দেশনা দিতে পারবে।
আইপিসিসির প্রতিবেদনটির লিংক দেওয়া হলো
https://www.ipcc.ch/report/ar6/wg1/
Comments