২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত প্যান স্টার্স (PAN STARRS) টেলিস্কোপ দিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানী রবার্ট ওয়েরিক সৌরজগতের একটি অংশ জরিপ করেছিলেন। এই টেলিস্কোপটির সাহায্যে সৌরজগতের অন্তর্গত বিভিন্ন ছোট খাটো মহাজাগতিক বস্তুর গতিবিধির উপর নজর রাখা হয়। সেই রাতে রবার্ট এই কাজটিই করছিলেন। এটি ছিল তাঁর রুটিন কাজের অংশ। হঠাৎ রবার্টের নজরে আসলো ছোট্ট একটি লম্বাটে বস্তু। এই অদ্ভুত বস্তুটি তিনি আগে কখনো দেখেন নি। এর অবস্থান তখন ছিল পৃথিবী থেকে প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন কিলোমিটার অর্থাৎ পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের প্রায় পঁচাশি গুণ বেশি দূরে।
রবার্ট একজন অভিজ্ঞ পেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানী। দীর্ঘ পেশাগত জীবনে মহাকাশে এ ধরনের কোন বস্তু এর আগে তাঁর চোখে পড়েনি। তিনি অবাক হলেন। রবার্ট প্রথমে ভেবেছিলেন, এটি হয়তো নতুন কোন ধুমকেতু অথবা অনাবিষ্কৃত কোন গ্রহাণু হবে। কিন্তু আরো কিছু দিন পর্যবেক্ষণ করার ফলে তাঁর ধারণাটি ভুল বলে প্রমাণিত হলো।
মহাকাশে বস্তুটির অবস্থান দেখে তিনি বুঝতে পারলেন, এটি সূর্য থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। সাধারণ কোন ধুমকেতু হলে সূর্যের বিপরীত দিকে এর একটি গ্যাসীয় লেজ দেখা যেত। কিন্তু অন্যান্য ধূমকেতুর মতো এই বস্তুটির কোন লেজ দেখা গেল না। নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পরিমাপ করে দেখা গেল, বস্তুটির দৈর্ঘ্য ১০০ থেকে ১০০০ মিটার এবং প্রস্থ ৩৫ থেকে ১৬৭ মিটারের মধ্যে। এর আকৃতি অনেকটা চুরুটের মত লম্বাটে। বস্তুটি লম্বাটে হলেও দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থে আহামরি তেমন বড় কিছু নয়। বর্ণালী বিশ্লেষণ করে দেখা গেল এর রং কিছুটা লালচে ধরনের। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এর গতি-প্রকৃতি সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহাণুর মত নয়।
হিসেব করে দেখা গেল, বস্তুটির উৎকেন্দ্রিকতা ( Eccentricity) সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহাণুদের চেয়ে অনেক বেশী। এর বিশাল অধিবৃত্তাকার গতিপথ বিশ্লেষণ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন এটি আমাদের সৌরজগতের অন্তর্গত কোন বস্তু নয়। এটি এসেছে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অন্য কোন প্রান্ত থেকে। এটি ছিলো জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি অনন্য আবিষ্কার। বিজ্ঞানীরা এই প্রথম সৌরজগতের ভেতরে কোন আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তুকে শনাক্ত করতে সক্ষম হলেন। তাঁরা এর নাম দিলেন, ওউমুয়ামুয়া (Oumuamua)। হাওয়াইয়ান ভাষায় এর অর্থ হলো, প্রথম বার্তাবাহক। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্যাটালগে এর সাংকেতিক পরিচয় দেয়া হলো, 1I/2017 U1, এখানে ইংরেজি আই অক্ষরটি দিয়ে ইন্টারস্টেলার বোঝানো হয়েছে।
এই আবিষ্কারের খবরটি জ্যোতির্বিজ্ঞানী মহলে ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই একে নিয়ে আগ্রহী হলেন। পৃথিবীর বড় বড় টেলিস্কোপ দিয়ে ওউমুয়ামুয়াকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু হলো। এর গতিবেগ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন, এর গতি মাঝে মাঝে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মহাকাশে অন্য কোন ধুমকেতু বা গ্রহাণুর ক্ষেত্রে গতিবেগের এরকম পরিবর্তন দেখা যায় না। এর গতি-প্রকৃতি দেখে কিছু কিছু বিজ্ঞানী দাবি করে বসলেন, ওউমুয়ামুয়া কোন প্রাকৃতিক মহাজাগতিক বস্তু নয়। এটি হলো উন্নত কোন এলিয়েন সভ্যতার প্রেরিত লাইট-সেইল ( light sail) জাতীয় মহাকাশ যান। দূরবর্তী কোন এলিয়েন সভ্যতা থেকে এই মহাকাশ যানটিকে আমাদের সৌরজগতের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছে। অনেকে একে আর্থার সি ক্লার্কের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ‘Rendezvous With Rama’ তে বর্ণিত সেই মহাকাশযানটির সাথে তুলনা করলেন। অবশ্য রেডিও টেলিস্কোপ দিয়ে ওউমুয়ামুয়াকে পর্যবেক্ষণ করে এর ভেতর থেকে কোন বেতার সংকেতের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
অধিকাংশ বিজ্ঞানীই মনে করেন ওউমুয়ামুয়া কোন এলিয়েন মহাকাশযান নয়। তাঁরা মনে করেন এটি একটি প্রাকৃতিক বস্তু। তবে এটি যে সৌরজগতের বাইরে থেকে এসেছে এ ব্যাপারে তাঁদের কোন সন্দেহ নেই। তাঁরা মনে করেন, ওউমুয়ামুয়া মহাকাশে ভাসমান একটি আইসবার্গ। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কোন এক নিভৃত কোণে পরম শূন্যতার কাছাকাছি তাপমাত্রায় এই আইসবার্গের সৃষ্টি হয়েছিলো। তবে এই আইসবার্গটি কি দিয়ে তৈরি হয়েছে সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অনেকে মনে করেন এটি নাইট্রোজেনের বরফ এবং ধূলিকণার সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে। আবার অনেকে মনে করেন, এটি হাইড্রোজেন বরফের জমাট বাঁধা খন্ড। এর গঠনের উপাদান নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন। এই রহস্যের জট এখনো খোলেনি।
ওউমুয়ামুয়ার ছোট আকৃতি এবং এর বিশাল দূরত্ব ও দ্রুতগতির জন্য পৃথিবীর বড় বড় টেলিস্কোপ দিয়েও এর স্পষ্ট ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। এখানে ওউমুয়ামুয়ার যে ছবিটি দেওয়া হয়েছে সেটি শিল্পীর তুলিতে আঁকা কল্পিত ছবি।
বর্তমানে ওউমুয়ামুয়া সৌরজগতের বাইরের দিকে দ্রুতগতিতে ধাবিত হচ্ছে। ২০২২ সাল নাগাদ এটি সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরে চলে যাবে। তারপর আবার যাত্রা করবে অন্তহীন আন্তঃনাক্ষত্রিক পথে। সৌরজগতে আর ফিরে আসবে না। মহাকাশের এই রহস্যময় আগন্তুক কি বার্তা দিয়ে গেলো কে জানে?
Comments