মহাবিশ্বের মহাবিস্ময়: ব্ল্যাকহোল

অষ্টাদশ শতাব্দীতে জন মিচেল নামে কেমব্রিজে একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনিই প্রথম ব্ল্যাকহোলের প্রাথমিক ধারণাটি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আকাশের দিকে যদি একটি কামানের গোলা ছোঁড়া হয়, গোলাটি পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে চলে যাবে না। বরং কিছুদূর উপরে উঠার পর পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে সেটি আবার নিচের দিকে নেমে আসবে। এটাই নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ বলের কথা। 

কিন্তু কামানের গোলাটির গতি যদি একটি নির্দিষ্ট গতির চেয়ে বেশি হয় তবে সেটি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে মহাশূন্যে চলে যাবে। তাকে আর থামানো যাবে না। ‌এই গতিটির পরিমাণ হলো সেকেন্ডে ১১ কিলোমিটার। একে বলা হয়, পৃথিবীর এসকেপ ভেলোসিটি (escape velocity)। ‌কামানের গোলার গতি কখনো এত বেশি হয় না। সেজন্য বেচারাকে পৃথিবীতেই ফিরে আসতে হয়।  

আমরা জানি, কোন নভোযানকে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে অন্য কোনো গ্রহে যেতে হলে এই এসকেপ ভেলোসিটি বা তার চেয়ে বেশি গতি অর্জন করতে হয়। কোন গ্রহ বা নক্ষত্রের এসকেপ ভেলোসিটি নির্ভর করে তার মহাকর্ষ বলের উপর। পৃথিবীর চেয়ে সূর্যের মহাকর্ষ বল অনেক বেশি। তাই সূর্যের এসকেপ ভেলোসিটিও পৃথিবীর চাইতে অনেক বেশি। সূর্যের এসকেপ ভেলোসিটি হলো সেকেন্ডে ৬১৭ কিলোমিটার। কিন্তু আলোর গতির কাছে সেটা অতি নগন্য। ‌আলোর গতি হলো সেকেন্ডে প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার। তাই আলোর পক্ষে সূর্যের এসকেপ ভেলোসিটি কাটিয়ে ওঠা কোন সমস্যাই নয়। বেশিরভাগ নক্ষত্রের এসকেপ ভেলোসিটিই আলোর গতির চেয়ে অনেক কম। সেজন্য অসংখ্য নক্ষত্রের আলো আমরা দেখতে পাই।  

১৭৮৩ সালে জন মিচেল বলেছিলেন, মহাবিশ্বে এমন অনেক নক্ষত্র থাকা সম্ভব যাদের এসকেপ ভেলোসিটি আলোর গতির চেয়েও বেশি। সেজন্য ওইসব নক্ষত্র থেকে কখনোই কোন আলোক রশ্মি বের হতে পারে না। তার ফলে সে সব নক্ষত্রকে আমরা কখনোই দেখতে পাই না। তিনি ঐসব অদৃশ্য নক্ষত্রের নাম দিয়েছিলেন "ডার্ক স্টার"। তিনি অবশ্য এর গঠনের কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেননি। কারণ সে যুগে বিজ্ঞান এত দূর অগ্রসর হয়নি। বর্তমান যুগে এসে এসব অদৃশ্য নক্ষত্রের নাম হয়েছে "ব্ল্যাকহোল"। ১৯৬৭ সালে এই নামটি দিয়েছিলেন জন হুইলার নামে একজন আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী। 

ব্ল্যাকহোল সৃষ্টির পেছনে মহাকর্ষ বলের প্রধান ভূমিকা রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মহাকর্ষ বলকে অন্যান্য বলের তুলনায় দুর্বল মনে হলেও মহাবিশ্বে এর প্রভাব সর্বব্যাপী। এর কারণ হলো দুটো। প্রথমত, মহাকর্ষ বল অনেক দূর থেকে কাজ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, মহাকর্ষ বল হলো আকর্ষণধর্মী। ‌মহাবিশ্বে নক্ষত্র সৃষ্টির মূলে রয়েছে মহাকর্ষ বল। হাইড্রোজেন গ্যাস মহাকর্ষ বলের প্রভাবে পুঞ্জিভূত হয়ে নক্ষত্রের সৃষ্টি হয়। নক্ষত্রের অভ্যন্তরে হাইড্রোজেন পরমাণুর পরস্পরের সংঘর্ষের ফলে থার্মো নিউক্লিয়ার ফিউশন (Fusion) প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর ফলে হাইড্রোজেন পরমাণু হিলিয়াম পরমাণুতে রূপান্তরিত হতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর শক্তির উদ্ভব হয়। নক্ষত্রটি তখন প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে। এভাবেই একটি নক্ষত্রের জন্ম হয়। এরপর নক্ষত্রটি জ্বলতে থাকে দীর্ঘদিন। কিন্তু এক সময় নক্ষত্রের হাইড্রোজেন জ্বালানি ফুরিয়ে যেতে থাকে। হিলিয়াম পরমাণুও আস্তে আস্তে আরো ভারী পরমাণুতে রূপান্তরিত হয়। ‌ ধীরে ধীরে নক্ষত্রের কেন্দ্রে আয়রনের মত ভারী পরমাণুর সৃষ্টি হয়। এই সময় নক্ষত্রটির আয়তন অনেক বৃদ্ধি পায়। এটি একটি বিশাল লোহিত দানব‌ (Red Giant) নক্ষত্রে পরিণত হয়। নক্ষত্রটি তখনও প্রজ্জ্বলিত থাকে। কিন্তু এর উত্তাপ কমে যায়। ‌তারপর আস্তে আস্তে নক্ষত্রটির হাইড্রোজেন জ্বালানি আরো ফুরিয়ে যায়। তখন সেটা সংকুচিত হতে হতে একটি শ্বেত বামন (White Dwarf) নক্ষত্রে রূপান্তরিত হয়। আর এভাবেই সাধারণত একটি নক্ষত্রের জীবনাবসান হয়।  

কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে নক্ষত্রের জীবনাবসান অন্যভাবেও হতে পারে। এ নিয়ে গবেষণা করে জগৎ বিখ্যাত হয়েছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞানী সুব্রামানিয়ান চন্দ্রশেখর। তিনি জানতেন নক্ষত্রের ভেতরে ইলেকট্রনের চাপ এবং নক্ষত্রের নিজস্ব মহাকর্ষ বল এ দুয়ের মাঝে একটি ভারসাম্য রয়েছে। এই ভারসাম্য থাকার ফলেই শ্বেত বামন নক্ষত্রটি মহাকর্ষ বলের প্রভাবে ধ্বংস (collapse) হয়ে যায় না। কিন্তু তিনি বললেন, এই ভারসাম্যটি নির্ভর করে নক্ষত্রটির ভরের উপর। তিনি অংক কষে বের করলেন, শ্বেত বামন নক্ষত্রের সর্বোচ্চ ভরসীমা হলো সৌর ভরের ১.৪৪ গুন । তার মানে হলো, কোন শ্বেত বামন  নক্ষত্রের ভর যদি সূর্যের ভরের চাইতে ১.৪৪ গুন অথবা তার বেশি হয় তবে সেটি আর শ্বেত বামন নক্ষত্র হিসেবে টিকে থাকতে পারবে না। নক্ষত্রটি তখন বিস্ফোরিত হবে। একে বলা হয় সুপারনোভা বিস্ফোরণ। 

নক্ষত্রটি সুপারনোভা হয়ে বিস্ফোরিত হবার পর তার সম্ভাব্য কী কী পরিণতি হতে পারে তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন। ‌তারা বলেছেন, বিস্ফোরিত নক্ষত্রটি একটি নিউট্রন নক্ষত্রে রূপান্তরিত হতে পারে অথবা প্রবল মহাকর্ষ বলের প্রভাবে এটি একটি ব্ল্যাকহোলেও পরিণত হতে পারে। ‌  

নিউট্রন নক্ষত্র গঠিত হয় শুধুই নিউট্রন কণা দিয়ে। এদের পরিধি মাত্র ১০-১৫ কিলোমিটার। কিন্তু ঘনত্ব অস্বাভাবিক বেশি। কিছু কিছু নিউট্রন নক্ষত্র রয়েছে যে গুলো তার নিজের অক্ষের উপর প্রচন্ড গতিতে ঘুরপাক খায়। এই ঘূর্ণির ফলে সেগুলো থেকে একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর রেডিও সিগন্যাল বের হয়। এই রেডিও সিগন্যাল দিয়ে নিউট্রন নক্ষত্র গুলোকে শনাক্ত করা যায়। বিজ্ঞানীরা এদের নাম দিয়েছেন, পালসার।  

আগেই বলেছি, বিস্ফোরিত হওয়ার পর নক্ষত্রটি মহাকর্ষ বলের প্রভাবে একটি ব্ল্যাকহোলেও পরিণত হতে পারে। মহাবিশ্বে ব্ল্যাকহোল এক অত্যন্ত বিস্ময়কর বস্তু। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীকেও হার মানায় বাস্তবের ব্ল্যাকহোল। একে বুঝতে হলে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব সম্বন্ধে কিছুটা জানতে হবে। 

‌আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব অনুসারে মহাবিশ্বে স্থান এবং কাল একই সূত্রে গাঁথা। যদিও সাদা চোখে স্থান এবং কালকে আমরা আলাদা মনে করি কিন্তু আইনস্টাইন বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে স্থান‌ এবং কালের যৌথ বুননেই মহাবিশ্বের অবকাঠামো গঠিত হয়েছে। একে বলা হয় স্পেস-টাইম, বাংলায় স্থান-কাল বলা যায়। বস্তুর উপস্থিতির জন্য স্থান-কালের চাদরে এক ধরনের কার্ভেচার বা বক্রতার সৃষ্টি হয়।‌ এই বক্রতাটিকেই আমরা মহাকর্ষ বল হিসেবে দেখি।‌ 

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সূর্যের উপস্থিতির জন্য তার চারপাশে স্থান-কালের চাদরের মাঝে যে বক্রতাটির সৃষ্টি হয়েছে সেটিকে অনুসরণ করেই পৃথিবী সহ অন্যান্য গ্রহ সূর্যকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করছে। ঠিক একইভাবে সূর্যও প্রদক্ষিণ করছে ছায়াপথ গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে ঘিরে। আইনস্টাইনের মতে, বস্তুর মহাকর্ষ বল হলো স্থান-কালের চাদরের বক্রতারই বহিঃপ্রকাশ। এটি একটি জ্যামিতিক ব্যাপার। বস্তুর ভর যত বেশি হবে তার চারপাশে স্থান-কালের চাদরে বক্রতার পরিমানও তত বেশি হবে। সেজন্য তার মহাকর্ষ বলও হবে তত বেশি। বলাই বাহুল্য, এমন যুগান্তকারী ধারণা আইনস্টাইনের আগে কারো মাথায় আসেনি। গত একশ বছরে, বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার  তত্ত্ব নির্ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। 

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, প্রবল মহাকর্ষ বলের প্রভাবে ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরে স্থান-কালের চাদরের বক্রতাটি অসীম আকার ধারণ করেছে। এর নাম তাঁরা দিয়েছেন, সিঙ্গুলারিটি। এখানে এসে স্থান এবং কাল একাকার হয়ে গেছে। সময় গেছে থেমে। পদার্থ বিজ্ঞানের স্বাভাবিক নিয়মগুলিও
এখানে খাটে না। সেজন্য ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরে কি ঘটছে সেটা নিশ্চিত করা বলা কঠিন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এটা জানেন, ব্ল্যাকহোলের মহাকর্ষ বল হলো সর্বগ্রাসী।‌ সেজন্য ব্ল্যাকহোল শনাক্ত করা অত্যন্ত কঠিন। প্রবল মহাকর্ষ বলের প্রভাবে ব্ল্যাকহোলের ভেতর থেকে কোন সিগন্যালই বের হতে পারে না। ব্ল্যাকহোলকে শনাক্ত করতে হয় পরোক্ষভাবে। ব্ল্যাকহোলের কাছাকাছি একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা রয়েছে, যেটা একবার অতিক্রম করলে সেখান থেকে ফেরার আর কোনো উপায় থাকে না। এই সীমার ভেতরে যে কোনো বস্তুকেই ব্ল্যাকহোল গ্রাস করে নেয়। এই সীমারেখাটির নাম হলো, ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা-দিগন্ত।  

এ প্রসঙ্গে আরেক জন বিজ্ঞানীর নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন। তাঁর নাম হলো, কার্ল শোয়ার্জশীল্ড। আইনস্টাইনের মতো তিনিও ছিলেন একজন জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার  সাধারণ তত্ত্বের ফিল্ড সমীকরণ সমাধান করে তিনি বস্তুর মহাকর্ষীয় ব্যাসার্ধ (gravitational radius) নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেজন্য কোন বস্তুর মহাকর্ষীয় ব্যাসার্ধকে বলা হয় শোয়ার্জশীল্ড ব্যাসার্ধ (Schwarzschild radius)। ব্ল্যাকহোলের শোয়ার্জচাশীল্ড ব্যাসার্ধটি এর কেন্দ্র থেকে শুরু করে ইভেন্ট হরাইজন পর্যন্ত বিস্তৃত। 

ব্ল্যাকহোলকে শনাক্ত করতে হয় ইভেন্ট হরাইজনের বাইরে থেকে। মজার ব্যাপার হলো,  ১৯১৯ সালে আইনস্টাইনের  আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রমানিত হওয়ার ঠিক একশ বছর পর, ২০১৯ সালে বিজ্ঞানীরা ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা  একটি ব্ল্যাকহোলের ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সেই ছবিটি তাঁরা প্রকাশ করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, ব্ল্যাকহোল থেকে যদি কোন আলোক রশ্মি বের হতে না পারে, তবে তার ছবি কিভাবে তোলা সম্ভব হলো? এটি সম্ভব হয়েছে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের মাধ্যমে। সারা পৃথিবী জুড়ে আটটি ইভেন্ট হরাইজন রেডিও টেলিস্কোপের সাহায্যে দূরবর্তী একটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে এই বিশাল আকৃতির ব্ল্যাকহোলটির সন্ধান পাওয়া গেছে। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্রটি সম্পূর্ণ অন্ধকার, কিন্তু এর প্রবল মহাকর্ষের প্রভাবে ইভেন্ট হরাইজনের বাইরের আলো বেঁকে যাচ্ছে। একশ বছরের ব্যবধানে আবারও প্রমাণিত হলো মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কালজয়ী তত্ত্ব।
   
এখানে বলে রাখি, ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ব্ল্যাকহোল নিয়ে গবেষণা  করতে গিয়ে কোয়ান্টাম  মেকানিক্সের আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি তাত্ত্বিকভাবে দেখিয়েছিলেন, ব্ল্যাকহোলের ইভেন্ট হরাইজনের সীমানায় এক ধরনের বিকিরণ হয়। অত্যন্ত কম তাপমাত্রার এই বিকিরণকে বলা হয়, হকিং রেডিয়েশন। কোয়ান্টাম শূন্যতার মাঝে যেসব ভার্চুয়াল কণা এবং প্রতিকণার উদ্ভব হয় তারই কিছুটা হকিং রেডিয়েশন হিসেবে ইভেন্ট হরাইজনের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। এর ফলে ধীরে ধীরে ব্ল্যাকহোল তার ভর হারায়। তবে হকিং রেডিয়েশনকে এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে ভবিষ্যতে যে সম্ভব হবেনা, সেটা বলা যায় না। 

মহাবিশ্বের সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য ব্ল্যাকহোল। দৃশ্যমান মহাবিশ্বের প্রায় প্রতিটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রেই রয়েছে বিশাল আকৃতির  ব্ল্যাকহোল। আমাদের নিজস্ব মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রেও রয়েছে এরকম একটি সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল। এর ভর ৪.৫ মিলিয়ন সৌরভরের সমান। এই সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলটি আবিষ্কার করার জন্য দুজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে গতবছর (২০২০) পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। 

তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানীরা  ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরে এক রহস্যময় জগতের সন্ধান দিয়েছেন। ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরীণ চরিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আপেক্ষিকতার পাশাপাশি তাঁরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আশ্রয় নিয়েছেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্স হলো পদার্থ বিজ্ঞানের আরেকটি প্রধান শাখা। এর কাজ কারবার হলো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণাদের নিয়ে। বিশাল মহাবিশ্বের চরিত্র ব্যাখ্যা করতে গেলে যেমন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার প্রয়োজন হয়, তেমনি বস্তুর অভ্যন্তরের অতি ক্ষুদ্র কণাদের চরিত্র ব্যাখ্যা করতে হলে প্রয়োজন হয় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের। সেজন্য পদার্থবিজ্ঞানে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের গুরুত্ব আপেক্ষিকতার চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। কোয়ান্টাম মেকানিক্সে এনট্যান্ঙ্গেলমেন্ট (entanglement) বলে একটি আশ্চর্য বিষয় রয়েছে। সোজা বাংলায় এর মানে হলো, পরস্পর জড়িয়ে থাকা।বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, প্রকৃতিতে দুটি বস্তুকণার উদ্ভব এমনভাবে হতে পারে, যেখানে একটি বস্তুকণার কোয়ান্টাম চরিত্র ব্যাখ্যা করলে অন্য বস্তুকণাটির কোয়ান্টাম চরিত্রও জানা যায়। যদিও আপাতদৃষ্টিতে দুটি বস্তুকণার মধ্যে সরাসরি কোন যোগাযোগ নেই এবং তাদের মধ্যে অনেক দূরত্বও রয়েছে। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য বন্ধনে কোয়ান্টাম জগতের একটি বস্তুকণা অন্য একটি দূরবর্তী বস্তুকণার সাথে জড়িয়ে থাকতে পারে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পরিভাষায় একে বলা হয় এনট্যান্ঙ্গেলমেন্ট। এটা অনেকটা ভুতুড়ে ব্যাপারের মত। এখানে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে পদার্থ বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মাবলীর পার্থক্য দেখা যায়। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, কোয়ান্টাম জগতে দূরবর্তী বস্তুকণার পরস্পরের সাথে জড়িয়ে থাকার এই ব্যাপারটি দিয়ে ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরীণ চরিত্র ব্যাখ্যা করা যায়।  

তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানীদের মতে, ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরে স্পেস-টাইমের অসীম বক্রতাটি একটি অদৃশ্য সুড়ঙ্গের আকার ধারণ করেছে। শুধু তাই নয়, স্পেস-টাইমের এই সুড়ঙ্গের মাধ্যমে বিশাল মহাবিশ্বে একটি ব্ল্যাকহোল অন্য একটি দূরবর্তী ব্ল্যাকহোলের সাথে সংযুক্ত অবস্থায় থাকতে পারে। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে, ব্ল্যাকহোল দুটো লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্পেস-টাইমের সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে তারা পরস্পরের সাথে সংযুক্ত অবস্থায় রয়েছে। স্পেস-টাইমের ভেতরের এই অদৃশ্য সুড়ঙ্গের নাম তাঁরা দিয়েছেন, ওয়ার্মহোল (wormhole)।  

ব্যাপারটি সাইন্স ফিকশনের মত মনে হলেও, ওয়ার্মহোলের ধারণাটি অবশ্য নতুন কিছু নয়। আইনস্টাইনের  আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যায়। আইনস্টাইন এবং তাঁর সহযোগী বিজ্ঞানী ন্যাথান রোজেন ১৯৩৫ সালে লেখা এক গবেষণা নিবন্ধে এর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তাঁরা অবশ্য তখন ওয়ার্মহোল নামটি ব্যবহার করেননি, বিজ্ঞানী মহলে তখন একে আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজ (Einstein-Rosen Bridge) নামে আখ্যায়িত করা হতো।  

বর্তমান যুগের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা ওয়ার্মহোলের ভেতরকার স্পেস-টাইমের চরিত্র নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁদের ধারণা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এনট্যান্ঙ্গেলমেন্টের ধারণাটি প্রয়োগ করেই ওয়ার্মহোলের ভেতরের স্পেস-টাইমের একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। তাদের মতে, ওয়ার্মহোলের ভেতরে কোয়ান্টাম এনট্যান্ঙ্গেলমেন্টের ফলে স্পেস-টাইম সব একাকার হয়ে গেছে। সেজন্য একটি ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরের বস্তুকণার কোয়ান্টাম চরিত্র জানা গেলে সংযুক্ত অন্য ব্ল্যাকহোলটির অভ্যন্তরীণ বস্তুকণার চরিত্রও জানা যাবে।
বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরে কোয়ান্টাম স্পেস-টাইমের রহস্যটি একদিন পরীক্ষার মাধ্যমে উদ্ঘাটিত হবে। এটি জানা গেলে, পদার্থবিজ্ঞানের দুটি প্রধান স্তম্ভ, আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপিত হবে। পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সেটি হবে একটি বিশাল মাইলফলক। মোদ্দা কথা হলো, ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরের যাবতীয় রহস্য জানতে আমাদের এখনো অপেক্ষা করতে হবে আরও অনেক বছর। 

কপিরাইট: তানভীর হোসেন।

Comments