কয়েক বছর আগে জেনিভা গিয়েছিলাম অফিসের কাজে। কাজ শেষ করে ফিরতি ফ্লাইট ধরার আগে বেশ কয়েক ঘন্টা সময় পেলাম। ভাবলাম, যাই সার্ন ঘুরে আসি। সার্ন (CERN) হলো ইউরোপিয়ান নিউক্লিয়ার রিসার্চ অর্গানাইজেশনের সংক্ষিপ্ত নাম। এখানে বিভিন্ন দেশের কয়েক হাজার বিজ্ঞানী কাজ করেন।
হোটেল থেকে ট্রেনে করে সার্নে পৌঁছাতে সময় লাগলো মাত্র আধা ঘন্টার মতো। জেনিভার কাছে সুইজারল্যান্ড এবং ফ্রান্সের সীমান্তে এর ঠিকানা। সার্নে পৌঁছেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। অপূর্ব সুন্দর এর প্রাকৃতিক পরিবেশ। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। দুরে দেখা যাচ্ছে বরফে ঢাকা সাদা পাহাড়ের সারি। এক কথায় যাকে বলে নয়নাভিরাম দৃশ্য।
ভিজিটর সেন্টারে গেলাম। ছুটির দিন। সেজন্য বেশ ভীড়। অনেক ডিসপ্লে এবং ইন্টার-একটিভ পোর্টালের সাহায্যে সার্নের কর্মকান্ড সুন্দর করে ব্যাখা করা হয়েছে। খুব সহজভাবে সাধারণ মানুষের জন্য তথ্যগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে। দেখে বেশ ভালো লাগলো।
সার্নে ছোট-বড় আটটি পার্টিকেল এক্সেলেটর রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বিশাল এবং শক্তিশালী হলো লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার। সংক্ষেপে একে বলা হয়, এল এইচ সি (LHC)। শুধু সার্নেই নয়, এটি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পার্টিকেল এক্সেলেটর। এল এইচ সি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিলো দশ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৮ সালে এটি চালু হয়েছিলো ।
ভূপৃষ্ঠের ১০০ মিটার নিচে এল এইচ সির অবস্থান। এর সাতাশ কিলোমিটার চক্রাকার টানেল চলে গেছে মাটির নিচ দিয়ে। এল এইচ সির কিছুটা অংশ রয়েছে ফ্রান্সে আর কিছুটা অংশ রয়েছে সুইজারল্যান্ডে। এল এইচ সির সুদীর্ঘ টানেলের বিভিন্ন স্থানে বসানো রয়েছে নয় হাজারেরও বেশি সুপার কন্ডাক্টিং ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেট। এগুলোকে রাখা হয়েছে মাইনাস ২৭১.৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায়, অর্থাৎ পরম শূন্যের খুব কাছাকাছি তাপমাত্রায়। সুপার কন্ডাক্টিং ম্যাগনেটগুলো এল এইচ সির ভেতরে অত্যন্ত শক্তিশালী চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে। তার ভেতর দিয়ে প্রোটন কণাগুলোকে প্রচন্ড গতিতে ত্বরান্বিত করা হয়।
এভাবে এল এইচ সির অভ্যন্তরে খুবই উচ্চশক্তির পরমাণু বিধ্বংসী পরীক্ষা চালানো হয়। ত্বরান্বিত প্রোটন কণাগুলোকে দুটি বিপরীত মুখী টিউব দিয়ে প্রবাহিত করে প্রায় আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর প্রোটন কণাদের মধ্যে ঘটানো হয় মুখোমুখি সংঘর্ষ। ১৩ ট্রিলিয়ন ইলেকট্রন-ভোল্ট শক্তির প্রচন্ড এই সংঘর্ষের ফলে প্রোটন কণাগুলো চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে তাদের আদি অবস্থায় ফিরে যায়। এটি হলো পদার্থের সেই পূর্বাবস্থা যেটি মহাবিশ্ব সৃষ্টির শুরুতে বিদ্যমান ছিল। মোদ্দা কথা হলো, এল এইচ সির ভেতরে কৃত্রিমভাবে বিগ ব্যাং এর পরবর্তী অবস্থার সৃষ্টি করা হয়। প্রোটন কণাদের মধ্যে প্রচন্ড সংঘর্ষের ফলে এল এইচ সির ভেতরে নানা ধরনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা উৎপন্ন হয়। এসব কণাগুলো অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু ক্ষণস্থায়ী হলেও এল এইচ সির অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের পার্টিকেল ডিটেকটরে সেগুলো ধরা পড়ে।
এমনি একটি কণা হলো হিগস-বোসন। তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই আদি কণাটি থেকেই অন্য সমস্ত বস্তুকণার ভরের উৎপত্তি হয়েছে। ষাটের দশকে ব্রিটিশ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী পিটার হিগস সর্বপ্রথম হিগস-বোসনের ধারণাটি দিয়েছিলেন। সেই থেকেই বিজ্ঞানীরা একে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তারা মনে করেন, এর সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্যের সুরাহা হবে না। একে অনেকে বলেন, দি গড পার্টিক্যাল। অবশেষে ২০১২ সালে এল এইচ সির একটি উচ্চশক্তির পরীক্ষায় হিগস-বোসন মশাই এক ঝলকের জন্য দেখা দিয়েছিলেন। এটি ছিলো একটি বিশাল আবিষ্কার। হিগস-বোসনকে খুঁজে পেতে বিজ্ঞানীদের সময় লেগেছে প্রায় অর্ধ শতাব্দী। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারটির জন্য ২০১৩ সালে পিটার হিগসকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিলো।
বিজ্ঞানীরা পদার্থের স্বরূপ উন্মোচন করতে চান। তারা জানতে চান বিগ ব্যাং এর মহাশক্তি থেকে পদার্থের প্রাথমিক রূপান্তর প্রক্রিয়াটি ঠিক কিভাবে ঘটেছিলো। এ নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানে এখনো কিছু কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়েছে। সেগুলোর উত্তর তাঁরা জানতে চান। মহাবিশ্বে পদার্থ এবং প্রতি-পদার্থের অসামাঞ্জস্য, সুপার সিমেট্রি, ডার্ক এনার্জি এবং ডার্ক ম্যাটার ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়কে তাঁরা ব্যাখ্যা করতে চান পরীক্ষার মাধ্যমে। সেই লক্ষ্যেই সার্নের বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন।
এগুলো হলো সার্নের উচ্চমার্গীয় ব্যাপার স্যাপার। যা আমাদের মত সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। কিন্তু সার্ন এমন একটি জিনিস আবিস্কার করেছে যা আমাদের নাগালের মধ্যেই রয়েছে। আমরা প্রতিদিনই এর ব্যবহার করছি। এটি হলো ইন্টারনেট। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের ব্যবহার সার্নেই প্রথম শুরু হয়েছিলো। সার্নের বিজ্ঞানীরা তাঁদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করার জন্য ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের উদ্ভাবন করছিলেন সেই আশির দশকে। সার্নে এসে এই অজানা তথ্যটি জানা হলো।
পদার্থ বিজ্ঞানের পূণ্যভূমি এবং ইন্টারনেটের জন্মভূমি সার্ন দেখা যখন শেষ হলো বেলা তখন গড়িয়ে গেছে। এবার আমার প্লেন ধরার তাড়া। মাত্র কয়েক ঘন্টা ছিলাম সার্নে। কিন্তু আমার স্মৃতিতে এখনো অম্লান হয়ে আছে সার্নে কাটানো সেই কয়েকটি মূল্যবান ঘন্টা।
সার্ন সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্যের জন্য:
https://home.cern/
Comments