আমি তখন স্কুলে পড়ি। "কবিতা ও বিজ্ঞান" নামে একটি প্রবন্ধ আমাদের পাঠ্য ছিলো। এর রচয়িতা স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী। উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা আবিস্কার করে তিনি জগত বিখ্যাত হয়েছিলেন। মার্কনির আগেই তিনি বেতার যন্ত্র তৈরী করেছিলেন কলকাতায় বসেই। এছাড়া আরো অনেক সফল গবেষণায় ব্যস্ত ছিলেন সারা জীবন। বিজ্ঞানী হলেও তিনি ছিলেন কবিতা প্রেমিক।
তাঁর প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, কবিতা ও বিজ্ঞানের মধ্যে মূলত কোনো বিরোধ নেই। কবি এবং বিজ্ঞানী দুজনেরই মূল লক্ষ্য একটি। সত্য ও সুন্দরের আরাধনা করা। প্রকৃতিকে জানা। এর অন্তর্নিহিত রহস্য উদঘাটন করা।
স্কুলের বালকের পক্ষে এত কঠিন কথা বুঝতে পারা সহজ নয়। অন্তত আমার পক্ষে তো নয়ই। আমার নিরেট মস্তিস্কে একথাটি কিছুতেই ঢুকতো না যে কবিতা ও বিজ্ঞান কি ভাবে এক হয়? স্কুলের বিজ্ঞানের পাঠ্য বিষয়গুলোকে আমার কাছে খুব নিরস বলে মনে হতো। কিন্তু কবিতা পড়তে ও আবৃত্তি করতে খুব ভালো লাগতো।
আমাদের স্কুলে বাংলা পড়াতেন আনিস সিদ্দিকী স্যার। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত লেখক। অনেক বই তিনি লিখেছেন ঐতিহাসিক চরিত্রদের নিয়ে। একদিন স্যারের কাছে কবিতা ও বিজ্ঞানের মধ্যে ঐক্যের ব্যাপারটি সম্বন্ধে জানতে চাইলাম । স্যার বললেন, এটা এখন বুঝবি না। আগে বড় হ', তারপর বুঝতে পারবি। আগে কবিতাকে বুঝতে শিখ। তাহলে বিজ্ঞানকে বুঝতে সুবিধা হবে।
জীবনে ছোট বড় অনেক কবির কবিতা পড়েছি। এখনো পড়ছি ও বোঝার চেষ্টা করছি। বিজ্ঞানকেও পেশা হিসাবে নিয়েছি। তাই বিজ্ঞানের চর্চা কিছুটা হলেও করতে হয়েছে। এই দুইয়ের মাঝে মিল ও অমিল দুইই লক্ষ্য করেছি। তবে মিলটাই বেশি মনে হয়েছে।
কবিরা সরাসরি কিছু বলেননা। তাঁরা জগতকে দেখেন তাঁদের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। সেটাকেই তাঁরা ভাবের ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেন তাঁদের কবিতায়। বিজ্ঞানীদেরও সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে। তবে বিজ্ঞানীরা কথা বলেন সরাসরি। তাঁরা যেটা দেখেন সেটাকে প্রমান করার চেষ্টা করেন পরীক্ষার মাধ্যমে। তাহলে মিলটা কোথায়? আসল কথা হলো, তাঁদের পদ্ধতি ভিন্ন হলেও, উদ্দেশ্য অভিন্ন। মিলটা হলো এখানেই। এটাই স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু বলতে চেয়েছেন।তাঁর ভাষায়,
"কবি এই বিশ্বজগতে তাহার হৃদয়ের দৃষ্টি দিয়া একটি অরূপকে দেখিতে পান, তাহাকেই তিনি রূপের মধ্যে প্রকাশ করিতে চেষ্টা করেন। অন্যের দেখা যেখানে ফুরাইয়া যায় সেখানেও তাহার ভাবের দৃষ্টি অবরুদ্ধ হয় না। সেই অপরূপ দেশের বার্তা তাহার কাব্যের ছন্দে ছন্দে নানা আভাসে বাজিয়া উঠিতে থাকে।বৈজ্ঞানিকের পন্থা স্বতন্ত্র হইতে পারে, কিন্তু কবিত্ব সাধনার সহিত তাহার সাধনার ঐক্য আছে। দৃষ্টির আলোক যেখানে শেষ হইয়া যায় সেখানেও তিনি আলোকের অনুসরণ করিতে থাকেন, শ্রুতির শক্তি যেখানে সুরের শেষ সীমায় পৌঁছায়, সেখান হইতেও তিনি কম্পমান বাণী আহরণ করিয়া আনেন। প্রকাশের অতীত যে রহস্য প্রকাশের আড়ালে বসিয়া দিনরাত্রি কাজ করিতেছে, বৈজ্ঞানিক তাহাকেই প্রশ্ন করিয়া দুর্বোধ্য উত্তর বাহির করিতেছেন এবং সেই উত্তরকে মানব-ভাষায় যথাযথ করিয়া ব্যক্ত করিতে নিযুক্ত আছেন।"
কবিতা ও বিজ্ঞানের মাঝে এই সুন্দর সম্পর্কের কথা বাংলা ভাষার আর কেউ কি এভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন?
Comments