আমাদের চেনা মহাবিশ্ব যে কত বিশাল সেটা চিন্তা করলে বিস্মিত হতে হয়। হাবল স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সির সন্ধান পাওয়া গেছে। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, এ সংখ্যাটি আরো অনেক গুন বেশি হতে পারে। তাদের মতে ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে এর চেয়েও অনেক বেশী গ্যালাক্সির সন্ধান পাওয়া যাবে। এত অসংখ্য গ্যালাক্সির মাঝে একটি অতি সাধারণ গ্যালাক্সি হলো আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। বাংলায় একে বলে, আকাশ-গঙ্গা ছায়াপথ। এটি আমাদের আবাসস্থল। আমাদের এই নিজস্ব গ্যালাক্সিটিতে ১০০ বিলিয়ন নক্ষত্র রয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। সূর্য হলো তারই মধ্যে একটি অতি সাধারন নক্ষত্র। এই নক্ষত্রটিকেই কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করছে আমাদের সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা পৃথিবী। সূর্যের আটটি গ্রহের একটি হলো আমাদের পৃথিবী। গ্রহটি আকারে আহমরি এমন কিছু বড় নয়।
হিসেব করে দেখা গেছে, পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বে এক বিলিয়ন ট্রিলিয়ন (একের পিঠে বাইশটি শুন্য দিলে যা হয়) নক্ষত্র রয়েছে। সংখ্যাটি যে অত্যন্ত বিশাল সেটা বলাই বাহুল্য। অনেকে বলেন, পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্র সৈকতে যে পরিমাণ বালুকণা রয়েছে, মহাবিশ্বে তারচেয়েও বেশি নক্ষত্র রয়েছে। এই বিশাল মহাবিশ্বে আমাদের পৃথিবীর অবস্থান যে অতি অকিঞ্চিৎকর সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বিশাল এই মহাবিশ্বের তুলনায় আমাদের অবস্থান অতি তুচ্ছ এবং নগণ্য।
এখন থেকে মাত্র একশো বছর আগেও মহাবিশ্ব বলতে বিজ্ঞানীরা শুধুমাত্র মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকেই বুঝতেন। এর বাইরে যে এতো অসংখ্য গ্যালাক্সি রয়েছে সে সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের কোন ধারণাই ছিল না। তাঁরা দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোকে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অন্তর্গত নীহারিকা (Nebula) মনে করতেন। ১৯২৩ সালে নিবিড় পর্যবেক্ষণের ফলে সর্বপ্রথম প্রমাণিত হয়, অ্যানড্রোমিডা (Andromeda) কোন নেবুলা বা নীহারিকা নয়, এটি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির বাইরে একটি স্বতন্ত্র গ্যালাক্সি। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব হলো ২.৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ। তার মানে হলো, এই গ্যালাক্সিটি থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছাতে সময় লাগে ২.৫ মিলিয়ন বছর। কিন্তু মহাজাগতিক স্কেলে অ্যানড্রোমিডা গ্যালাক্সিটি আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির একটি অতি নিকট প্রতিবেশী।
টেলিস্কোপ প্রযুক্তিতে অনেক উন্নতি হওয়ার ফলে ক্রমান্বয়ে আরও অসংখ্য গ্যালাক্সি আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব গ্যালাক্সি থেকে পাওয়া আলোক রশ্মির বর্ণালী বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখতে পাচ্ছেন, গ্যালাক্সিগুলো খুব দ্রুতই পরস্পরের কাছ থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। এর ফলে বোঝা যাচ্ছে মহাবিশ্ব মোটেই স্থির নয়। বরং সময়ের সাথে সাথে মহাবিশ্ব ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। তার মানে হলো, আমরা যদি সময়ের বিপরীতে সুদূর অতীতে ফিরে যাই, তাহলে একসময় দেখতে পাবো, সমস্ত গ্যালাক্সির যাবতীয় বস্তু একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত অবস্থায় ছিলো। এর পেছনে ফিরে যাওয়ার আর কোন উপায় নেই। সময় এখানে এসে থেমে গেছে। এই অবস্থাকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই সিঙ্গুলারিটির ভেতরে স্থান, কাল, বস্তু সব একীভূত অবস্থায় ছিল। এখান থেকেই মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, এখন থেকে প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে, এই সিঙ্গুলারিটির ভেতর একটি ঘটনা ঘটেছিলো। এর নাম হলো বিগ ব্যাং (Big Bang)। যদিও নাম শুনে মনে হচ্ছে, এটি ছিলো একটি মহাবিস্ফোরণ, কিন্তু আসলে এটি কোন সাধারণ বিস্ফোরণ ছিল না। এটি ছিলো একটি রূপান্তর প্রক্রিয়া, যার ফলে মহাবিশ্বে স্থান-কাল এবং বস্তুর সৃষ্টি হয়েছিলো। বিগ ব্যাং সম্বন্ধে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, এক ধরনের মহাজাগতিক বিকিরণ থেকে। এর নাম হলো, কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন। বিগ ব্যাং এর ফলে উদ্ভূত এই মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ মহাবিশ্বের সবদিকে সমভাবে ছড়িয়ে আছে। আগেকার দিনের এনালগ টেলিভিশনে চ্যানেল না থাকলে যে ঝিরঝির ছবি এবং শিরশির শব্দ হতো, সেটার উৎস হলো এই কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই বিগ ব্যাং এর নির্গত শক্তি থেকেই ধাপে ধাপে মহাবিশ্বের যাবতীয় বস্তু কণার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মতে বিগ ব্যাং এর পর প্রথম তিনটি মিনিট ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।মহাবিশ্বের যাবতীয় প্রাথমিক বস্তুকণা এই প্রথম তিন মিনিটের মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছিলো। বিগ ব্যাং এর মহাশক্তি থেকে প্রাথমিক বস্তুকণার রূপান্তর কিভাবে হয়েছিল তার ব্যাখ্যা তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, এর ফলে অতি উচ্চ তাপমাত্রায় প্রচন্ড শক্তি নির্গত হয়েছিলো। এক হাজার ট্রিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার এই মহাশক্তি থেকে খুব দ্রুতই কিছু প্রাথমিক বস্তুকণার উদ্ভব হয় যা প্রথম তিন মিনিটের মধ্যেই কয়েক ধাপে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম পরমাণুতে রূপান্তরিত হয়েছিলো। আইনস্টাইন তাঁর বিখ্যাত সমীকরণে (E = mc^2) দেখিয়েছেন, বস্তুকে যেমন শক্তিতে রূপান্তরিত করা সম্ভব, তেমনি শক্তিকেও বস্তুতে রূপান্তরিত করা অসম্ভব নয়। মহাবিশ্বের সূচনায় এই অসম্ভবটিই সম্ভব হয়েছিলো। এর পরপরই মহাবিশ্বের প্রসারণ শুরু হয়, যা এখনো ক্রমেই প্রসারিত হয়েই চলেছে। পরবর্তীতে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম পরমাণু মহাকর্ষের ফলে পুঞ্জীভূত হয়ে বিভিন্ন গ্যালাক্সি, নেবুলা এবং নক্ষত্রের জন্ম দিয়েছে, যা এখন আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বের অংশ। এটি হলো বিজ্ঞানীদের কাছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির সবচাইতে পছন্দনীয় এবং গ্রহণযোগ্য মডেল।
তবে বিজ্ঞানে শেষ কথা বলে কিছু নেই। বেশ কিছু তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী আছেন, যারা মনে করেন, আমাদের চেনা মহাবিশ্বই শেষ কথা নয়। এর বাইরেও রয়েছে অসংখ্য অচেনা মহাবিশ্ব। চেনা মহাবিশ্বের বাইরে এই অনন্ত মহাবিশ্বের নাম তাঁরা দিয়েছেন, মাল্টিভার্স (Multiverse)। অনেকে আবার একে বলেন, প্যারালাল ইউনিভার্স। এসব অচেনা মহাবিশ্বগুলো আমাদের চেনা মহাবিশ্বের সমান্তরাল কিন্তু তাদের প্রাকৃতিক নিয়মকানুনগুলো আমাদের চেনা মহাবিশ্বের মত নয়, সম্পূর্ণ আলাদা। একে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মনে হতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞান কোন কোন সময় কল্পকাহিনীকেও হার মানিয়ে দেয়। বর্তমান যুগের কসমোলজিতে মাল্টিভার্স তত্ত্ব এমনি এক আশ্চর্য বিষয়।
এ নিয়ে আলোচনা করার আগে কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে একটু কথা বলতে হবে। আমরা জানি, পদার্থের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাদের জগৎটি বড়ই বিস্ময়কর এবং অদ্ভুত। এই জগতের নিয়ামক হলো কোয়ান্টাম মেকানিক্স। পদার্থবিজ্ঞানের অন্যান্য সাধারণ নিয়মগুলো এখানে খাটে না। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম অনুসারে কোন বস্তুকণার অবস্থা নিশ্চিত ভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। মোদ্দা কথা হলো, কোয়ান্টাম জগতে একটি বস্তুকণা একই সময়ে একাধিক অবস্থায় থাকতে পারে। কোয়ান্টাম বস্তুকণার এই বৈশিষ্ট্যকে বলা হয়,"সুপারপজিশন"
(superposition)।সেজন্য আমরা একই সময়ে, কোয়ান্টাম কণার ভিন্ন ভিন্ন অবস্থাগুলো একই সাথে পর্যবেক্ষণ করতে পারিনা। যেমন একটি বস্তুকণা একটি নির্দিষ্ট সময়ে কণা হিসেবে থাকতে পারে, আবার তরঙ্গ হিসেবেও থাকতে পারে। কিন্তু একই সাথে আমরা কখনও এ দুটো অবস্থা দেখতে পাই না। বস্তুকণার কোয়ান্টাম অবস্থা নির্ণয় করতে হয় সম্ভাব্যতা বা প্রবাবিলিটি দিয়ে। আলবার্ট আইনস্টাইন অবশ্য কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তিতে ছিলেন। তিনি সরাসরি বলেছিলেন, "ঈশ্বর মহাবিশ্বকে নিয়ে পাশা খেলেন না" (God does not play dice with the universe)। বলাই বাহুল্য তাঁর কাছে "সম্ভাব্যতা" ব্যাপারটা খুব গোলমেলে ঠেকেছিলো।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একজন দিকপাল ছিলেন আরউইন শ্রোডিঙ্গার। ১৯২৬ সালে শ্রোডিঙ্গারই সর্বপ্রথম তাঁর ওয়েভ ফাংশন সমীকরণের সাহায্যে বস্তুকণার কোয়ান্টাম অবস্থার সম্ভাব্যতা নির্ণয় করেছিলেন। কিন্তু তিনি এটাও জানতেন, আমাদের পারিপার্শ্বিক দৃশ্যমান জগতে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়মগুলি প্রয়োগ করলে সমস্যা দেখা যাবে। তিনি বিড়াল নিয়ে একটি কাল্পনিক পরীক্ষার মাধ্যমে এটি জনসম্মুখে তুলে ধরেছিলেন। এই কাল্পনিক পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছিলেন একটি বন্ধ বাক্সের মধ্যে একটি বিড়ালের পক্ষে কোয়ান্টাম জগতে জীবিত এবং মৃত দুই অবস্থায়ই থাকা সম্ভব। যেটি বাস্তবে অসম্ভব। শ্রোডিঙ্গার বিড়াল নিয়ে তাঁর এই কাল্পনিক পরীক্ষার মাধ্যমে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন, বস্তুকণাদের জগতে সুপার পজিশনের ধারণাটি প্রয়োগ করা গেলেও, আমাদের দৃশ্যমান পারিপার্শ্বিক জগতে এর প্রয়োগ বাস্তবসম্মত নয়। এই দুই জগতের নিয়ম বড়ই আলাদা।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সে অবশ্য আরও গোলমেলে ব্যাপার রয়েছে। যেমন ধরুন, কোয়ান্টাম মেকানিক্সে এনট্যান্ঙ্গেলমেন্ট (entanglement) বলে একটি ব্যাপার আছে। সোজা বাংলায় এর মানে হলো, পরস্পর জড়িয়ে থাকা। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, প্রকৃতিতে দুটি বস্তুকণার উদ্ভব এমনভাবে হতে পারে, যেখানে একটি বস্তুকণার কোয়ান্টাম চরিত্র ব্যাখ্যা করলে অন্য বস্তু কণাটির কোয়ান্টাম চরিত্রও জানা যায়। যদিও আপাতদৃষ্টিতে দুটি বস্তুকণার মধ্যে সরাসরি কোন যোগাযোগ নেই এবং তাদের মধ্যে অনেক দূরত্বও রয়েছে। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য বন্ধনে কোয়ান্টাম জগতের একটি বস্তুকণা অন্য একটি দূরবর্তী বস্তুকণার সাথে জড়িয়ে থাকতে পারে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পরিভাষায় একে বলা হয় এনট্যান্ঙ্গেলমেন্ট। এটা অনেকটা ভুতুড়ে ব্যাপারের মত। এখানে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে পদার্থ বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মাবলীর পার্থক্য দেখা যায়।
বিজ্ঞানীরা বস্তুকণার চরিত্র নিয়ে যতই গবেষণা করেছেন তাদের কাছে কোয়ান্টাম কণাদের অনিশ্চয়তার এবং জড়িয়ে থাকার বিষয়টি ততই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কোয়ান্টাম জগতের বস্তুকণাদের এই অদ্ভুত আচরণের ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা নানাভাবে দিয়েছেন। তবে এর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাখ্যাটি দিয়েছেন, হিউ এভারেট (Hugh Everett) নামে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির একজন গবেষক। ১৯৫৩ সালে তিনি বলেছিলেন, কোয়ান্টাম কণাদের এই দ্বৈত আচরণ আসলে ঘটছে দুটো ভিন্ন মহাবিশ্বে। পর্যবেক্ষক দুটো ভিন্ন মহাবিশ্ব থেকে একে আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। সেজন্য আমরা একই সাথে বস্তুকণার দুটো অবস্থা দেখতে পাই না। দুটি ভিন্ন মহাবিশ্বে কোয়ান্টাম বস্তুকণারা পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকলেও, দৃশ্যমান জগতে পর্যবেক্ষক পরস্পরের সাথে যুক্ত নয়। তাঁর এই বহু জাগতিক (multi-world) ব্যাখ্যাটি সে সময় যথেষ্ট হাস্যরসের সৃষ্টি করেছিলো ঠিকই, কিন্তু সেই সাথে এ ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহও সৃষ্টি হয়েছিলো।
বর্তমান যুগের একদল তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়মকে মহাবিশ্ব সৃষ্টির তত্ত্বের সাথে একীভূত করে মাল্টিভার্স বা অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণাটি দিয়েছেন। আগেই বলেছি একটি বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিলো। কিন্তু বিগ ব্যাং কেন হয়েছিলো সে ব্যাপারটি বিজ্ঞানীদের কাছে এখনও স্পষ্ট নয়। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, বিগ ব্যাং এর পরপরই মহাবিশ্ব ব্যাপক হারে স্ফীত (inflation) উঠেছিলো। এর কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছেন মহাকর্ষ বলকে। যদিও আমরা জানি মহাকর্ষ বল হলো আকর্ষণধর্মী, কিন্তু বিগব্যাংয়ের পরপরই প্রচন্ড শক্তির প্রভাবে মহাকর্ষ বল বিকর্ষণধর্মী হয়ে গিয়েছিল। এই বিকর্ষণধর্মী মহাকর্ষ বলের প্রভাবে মহাবিশ্ব অতি দ্রুত হারে স্ফীত হতে শুরু করে। বিজ্ঞানীদের হিসেবে, জ্যামিতিক হারে এই ব্যাপক স্ফীতিটি হয়েছিলো বিগব্যাং ঘটার ১০^-৩৭ থেকে ১০^-৩৫ সেকেন্ডের মধ্যে। এই অতি সামান্য সময়ের মধ্যেই মহাবিশ্বের আয়তন জ্যামিতিক হারে ১০০ বার বৃদ্ধি পায়।বিজ্ঞানীরা মনে করেন, অতি সামান্য সময়ে এই অতি দ্রুত স্ফীতির হার সর্বত্র সুষম ছিলনা। সেজন্য স্ফীতি কালীন সময়ে এর ভেতর বুদবুদের মত অসংখ্য বলয় সৃষ্টি হয়েছিলো। এই বলয়গুলোই পরবর্তীতে ভিন্ন ভিন্ন মহাবিশ্ব হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। এর ফলে একটি বিগব্যাং থেকেই একটির পরিবর্তে অনন্ত মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে। এসব মহাবিশ্বগুলো একে অপরের কাছে দৃশ্যমান নয়। এদের প্রাকৃতিক নিয়মগুলোও ভিন্ন। কিন্তু কোয়ান্টাম জগতের বস্তুকণার মতই এরা সমান্তরালভাবে বিরাজমান। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা অনন্ত মহাবিশ্বের সংখ্যাও হিসেব করে বের করেছেন। সংখ্যাটি হলো ১০^১০^১৬। বলাই বাহুল্য, সংখ্যাটি অবিশ্বাস্য রকমের বড়। অনন্ত মহাবিশ্ব যে কত বিশাল সেটা ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে ধারণা করাটি কঠিন।
বর্তমান যুগের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত স্ট্রিং থিওরী অনুযায়ী আমাদের দৃশ্যমান ত্রিমাত্রিক জগৎটাই সবকিছু নয়। এর বাইরেও অদৃশ্য আরো ছয়টি ডাইমেনশন রয়েছে। যার দেখা আমরা কখনোই পাই না। স্ট্রিং থিওরী অনুযায়ী মাল্টিভার্স বা প্যারালাল ইউনিভার্সের ধারনাটি সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে আমাদের পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধতার জন্য একে প্রমাণ করাও সম্ভব নয়।
আপনি যখন আমার এই লেখাটি পড়ছেন, তখনই হয়তো অন্য কোন সমান্তরাল মহাবিশ্বে আপনারই মত একজন এই লেখাটি পড়ে আপনারই মতন মুচকি মুচকি হাসছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো তার সাথে আপনার কোনদিনই দেখা হবে না। সেজন্যই হয়তো মরমী কবি লালন ফকির বলেছেন, "বাড়ির কাছে আরশিনগর, সেথা এক পড়শি বসত করে, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে"।
শুরুতেই বলেছি মহাবিশ্বের তুলনায় আমাদের পৃথিবী নামক গ্রহটি অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই ক্ষুদ্র গ্রহটিতে মানুষ নামে একটি নগণ্য প্রাণী বাস করে, যে তার দেড় কেজি ওজনের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কটির মেধা ও মননকে কাজে লাগিয়ে অনন্ত বিশাল মহাবিশ্বের সমস্ত রহস্যকে খুঁজে বের করার দুরূহ প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। একাজে সে সফল হবে কিনা সেটা একমাত্র ভবিতব্যই বলতে পারে।
Comments