আজ প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী অমল কুমার রায়চৌধুরীর জন্মদিন। ১৯২৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর, অবিভক্ত বাংলার বরিশালে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। তাঁর বাবা ছিলেন গণিতের শিক্ষক। বাবার কাছ থেকেই তাঁর গণিতে হাতে খড়ি হয়েছিলো। পরবর্তীতে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে মাস্টার্স করেছিলেন। তারপর শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন স্যার আশুতোষ কলেজে। এখানেই তিনি আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে তাঁর গবেষণার কাজ শুরু করেন। সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি তাঁর বিখ্যাত সমীকরণটি আবিষ্কার করেন।পদার্থবিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয় "রায়চৌধুরী সমীকরণ"। এই সমীকরণের মাধ্যমেই অমল কুমার রায়চৌধুরী সারা পৃথিবীতে খ্যাতি লাভ করেছিলেন।
"রায়চৌধুরী সমীকরণ" সম্বন্ধে
খুব সুন্দর এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে বাংলা উইকিপিডিয়াতে। এ সম্বন্ধে যারা জানতে চান, তাদের জন্য বাংলা উইকিপিডিয়া থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
"চতুর্মাত্রিক জগৎ সময়ের সাথে সাথে কীভাবে বিবর্তিত হয় সেটার ব্যাখ্যা মেলে এই সমীকরণ থেকে। এই সমীকরণ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ব্যাখ্যা করা যায়। নিউটন তার বিখ্যাত মহাকর্ষ সূত্রে বলেছিলেন, মহাবিশ্বের যে কোন দুটি বস্তুকণার মধ্যে মহাকর্ষ নামক একটি আকর্ষণধর্মী বল কাজ করে। কিন্তু এই বলের উৎস কী- সেটা নিউটন কখনোই বলে যেতে পারেননি। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে এটা প্রমাণিত হয়- মহাকর্ষ কোন বল নয়, এটা আমাদের চতুর্মাত্রিক স্থান-কালের একটা বৈশিষ্ট্য। কোন বস্তুর উপস্থিতিতে স্থান-কাল বেঁকে যায়, আর সেই বক্রতার জন্যই আমরা মহাকর্ষের প্রভাব দেখতে পারি। এখন প্রশ্ন হলো- মহাকর্ষের আকর্ষণধর্মীতার ব্যাখ্যা কী? আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখি যে, গাছ থেকে ফল মাটিতে পড়ছে, চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। অথচ আইনস্টাইনের দেওয়া ব্যাখ্যায় মহাকর্ষ একটি সম্পূর্ণ জ্যামিতিক ব্যাপার। তাহলে সেই জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্যের কোথায় এই আকর্ষণধর্মীতার ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে? রায়চৌধুরী সমীকরণ থেকে আমরা এটার খুব সুন্দর একটা ব্যাখ্যা পাই। কোনো ধরনের বলের প্রভাব ছাড়া একটি বস্তু যে পথে চলাচল করে, সেটাকে বলা হয় জিওডেসিক। রায়চৌধুরী দেখান যে, কোনো ভারী বস্তুর উপস্থিতিতে তার আশেপাশে জিওডেসিকগুলো বস্তুটির দিকে বেঁকে যায়। এটাই মহাকর্ষের আকর্ষণধর্মীতার ব্যাখ্যা দেয়।
রায়চৌধুরী সমীকরণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল রয়েছে। আমরা জানি যে, এই মহাবিশ্বের শুরু হয়েছে বিগ ব্যাং নামক এক মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। ধরে নেওয়া যাক, আমি কোন একটি বস্তুর সমগ্রজীবনের ইতিহাস জানতে চাই। তাহলে আমাকে যেটা করতে হবে, সেটা হলো চার মাত্রার জগতে বস্তুটা যে পথে চলেছে সেই পথ ধরে সময়ে পেছন দিকে যেতে থাকতে হবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো- এই পেছাতে পেছাতে যখন আমরা বিগ ব্যাং এর কাছাকাছি সময় গিয়ে পৌঁছাব তখন আর বলতে পারব না এর আগে কী হয়েছিল। অর্থাৎ আমাদের জগতের যেকোন বস্তুর চলার শুরু ঐ বিগ ব্যাং থেকেই, এর আগের কিছু জানা আমাদের জন্য সম্ভব নয়। যখনই জগতের কোন এক জায়গায় আমরা এভাবে আটকে যাই, আমরা বলি সেখানটায় একটা সিঙ্গুলারিটি আছে। প্রশ্ন হলো- জগৎ সৃষ্টি হওয়ার তত্ত্বে এই সিঙ্গুলারিটিকে কি কোনোভাবে এড়ানো সম্ভব? আইনস্টাইনের তত্ত্ব থেকে আমরা এমন কোন বিশ্বজগতের ধারণা কি পেতে পারি, যেখানে কোন সিঙ্গুলারিটি নেই। এই প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে প্রথম ধারণা পাওয়া যায় রায়চৌধুরী সমীকরণ থেকে। সেখান থেকে এটা দেখানো যায় যে, আমাদের মহাবিশ্বে যেকোন দুটি বস্তুকণার চলার পথ ধরে সময়ে পেছন দিকে যেতে থাকলে সেগুলো একটা জায়গায় গিয়ে জড়ো হতে চাইছে। সেটাই বিগ ব্যাং। অমল রায়চৌধুরীই প্রথম ধারণা দেন যে, সিংগুলারিটি এড়িয়ে যাওয়া আমাদের জন্য সম্ভব নয়। পরে ১৯৬০-৭০ এর দিকে স্টিফেন হকিং এবং রজার পেনরোজ, রায়চৌধুরী সমীকরণের উপর ভিত্তি করেই এ ব্যাপারটা গাণিতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন"।
অধ্যাপক রায়চৌধুরী ছিলেন বিরল প্রতিভার অধিকারী। শিক্ষক হিসেবেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তার ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ২০০৫ সালের ২৫ জুলাই ৮১ বছর বয়সে এই ক্ষণজন্মা বিজ্ঞানী পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন।
আমাদের দেশে অনেক প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁদের অনেকেরই অনন্য অবদান রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এখন তাঁদের কথা জানে না। আমাদের তরুণ সমাজকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলতে হলে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁদের অবদানের কথা জানাটা খুবই প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র: বাংলা উইকিপিডিয়া।
Comments