শান্ত নবীন গ্যালাক্সি

অতি সম্প্রতি পৃথিবী থেকে ১২ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে একটি নবীন গ্যালাক্সি আবিষ্কৃত হয়েছে। সাতজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর একটি আন্তর্জাতিক টিম চিলেতে অবস্থিত ALMA (Atacama Large Millimeter Array) টেলিস্কোপের সাহায্যে এর সন্ধান পেয়েছেন। এই আবিষ্কারটি নিয়ে এ সপ্তাহে বিশ্বখ্যাত নেচার জার্নালে তাঁদের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। 

এখানে বলে রাখি, ALMA একটি অত্যন্ত শক্তিশালী রেডিও টেলিস্কোপ। এই টেলিস্কোপের মোট ৬৬ টি ডিস এন্টেনা রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার মিটার উচ্চতায়, উত্তর চিলের আটাকামা উপত্যকায় এই এন্টেনাগুলো সারিবদ্ধভাবে বসানো রয়েছে। ALMA টেলিস্কোপের সাহায্যে মহাবিশ্বের অনেক দূরবর্তী বস্তুকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। ২০১৩ সাল থেকে এই টেলিস্কোপের ব্যবহার শুরু হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এখানে এসে গবেষণা করছেন। এর ফলে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এই নবীন গ্যালাক্সিটি আবিষ্কৃত হয়েছে। 

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই নতুন আবিষ্কৃত গ্যালাক্সিটিকে সাংকেতিকভাবে (SPT-SJ041839-475.9) চিহ্নিত করেছেন। মহাবিশ্বে দূরত্বের বিবেচনায় এটি একটি অত্যন্ত দূরবর্তী গ্যালাক্সি। এই গ্যালাক্সিটি পর্যবেক্ষণ করার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা  অত্যাধুনিক গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন। যার ফলে দূরবর্তী এই গ্যালাক্সিটির অনেক খুঁটিনাটি তাঁরা নির্ভুলভাবে বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন।

বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন এই নতুন গ্যালাক্সিটি থেকে পৃথিবীতে রেডিও সিগন্যাল এসে পৌঁছাতে সময় লাগছে প্রায় ১২ বিলিয়ন বছর। তার মানে হলো পৃথিবী থেকে রেডিও টেলিস্কোপ দিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এখন যা পর্যবেক্ষণ করছেন সেটি হলো গ্যালাক্সিটির ১২ বিলিয়ন বছর আগের অবস্থা। তাঁদের হিসেবে গ্যালাক্সিটির বয়স তখন ছিল মাত্র ১.৪ বিলিয়ন বছর। মহাজাগতিক বিচারে এটি একটি নবীন গ্যালাক্সি। বলা যায় প্রায় শিশু।

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, নবীন এই গ্যালাক্সিটি অনেকটা আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের মতই স্থিতিশীল। আমাদের গ্যালাক্সির মতোই এই নবীন গ্যালাক্সিটিরও একটি সমতল ঘূর্ণায়মান ডিস্ক রয়েছে। শুধু তাই নয়, আমাদের গ্যালাক্সির মত এই নবীন গ্যালাক্সির কেন্দ্রটিও কিছুটা স্ফীত। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সেজন্য ধারণা করছেন, এই গ্যালাক্সিটির কেন্দ্রেও আমাদের গ্যালাক্সির মতই প্রচুর নক্ষত্র রয়েছে। এর আগে কোন নবীন গ্যালাক্সির ক্ষেত্রে এ ধরনের আকৃতি কখনো দেখা যায়নি। এই নবীন গ্যালাক্সিটি আবিষ্কার করার পর  জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা খুবই বিস্মিত হয়েছেন। কারণ তাঁদের এই নতুন আবিষ্কারটি আদি মহাবিশ্বের গ্যালাক্সির গঠন নিয়ে বিজ্ঞানীদের প্রচলিত ধারণার সাথে খাপ খাচ্ছে না। 

জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানদের হিসেব মতে এখন থেকে ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে একটি মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং (big bang) এর ফলে আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিলো। এর পরপরই মহাবিশ্বের প্রসারণ শুরু হয়। মহাবিশ্ব এখনো ক্রমেই প্রসারিত হয়েই  চলেছে। পরবর্তীতে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম পরমাণু মহাকর্ষের ফলে পুঞ্জীভূত হয়ে বিভিন্ন গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, নেবুলা ইত্যাদির জন্ম দিয়েছে। এগুলো এখন আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বের অংশ। 

কিন্তু বিজ্ঞানীরা এটাও জানেন মহাবিস্ফোরণের পর প্রাথমিক অবস্থায় মহাবিশ্ব খুব অশান্ত অবস্থায় ছিল। বিশেষত সদ্য সৃষ্ট গ্যালাক্সিগুলোর ভেতরে পারস্পরিক সংঘর্ষ এবং অভ্যন্তরীণ সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে গ্যালাক্সিগুলো খুবই অস্থিতিশীল অবস্থায় ছিল। নবীন গ্যালাক্সিগুলোর তাপমাত্রা ছিল অনেক বেশি। এর আগে প্রাপ্ত সব তথ্য উপাত্তেই এটা দেখা গেছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই সদ্য আবিষ্কৃত নবীন গ্যালাক্সিটির ভেতর সে ধরনের কোনো অশান্ত অবস্থার লক্ষণই দেখা যায়নি। বিস্ময়করভাবে এই নবীন শান্ত গ্যালাক্সিটি আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সির মতোই স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। ‌ মোদ্দা কথা হলো, নবীন গ্যালাক্সি নিয়ে প্রচলিত ধারণার সাথে একে‌ কোনক্রমেই মেলানো যাচ্ছে না। এটি একটি সম্পূর্ণ নতুন আবিষ্কার। 
এই চমকপ্রদ আবিষ্কারটির মাধ্যমে মহাবিশ্বের প্রাথমিক পর্যায়ে গ্যালাক্সিদের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে বিজ্ঞানীদের ধারনা আরো স্পষ্ট হবে বলে আশা করছি। 

Comments