TLR7 জিন মিউটেশন এবং করোনাভাইরাস

নেদারল্যান্ডসে কয়েক মাস আগে দুই সহোদর ভাই কোভিড ১৯ রোগাক্রান্ত হয়েছিলেন। এদের একজনের বয়স হলো ৩১। অপরজনের বয়স ছিলো ২৯। তাদের দুজনেরই এর আগে কোনো রকম শারীরিক অসুস্থতা ছিল না। তারা দু'জনেই ছিলেন দিব্যি সুস্থ সবল যুবক। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হয়ে দুই ভাই খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। হাসপাতালে তাদের দুজনেরই শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হলো। তখন দু'জনকেই ভেন্টিলেশনে দিতে হলো। দুর্ভাগ্যবশত ছোট ভাই চিকিৎসারত অবস্থায়ই মারা গেলেন। আর বড় ভাই মুমূর্ষ অবস্থা থেকে অতিকষ্টে আরোগ্য লাভ করলেন। ডাচ চিকিৎসকরা তখন বুঝতে পারলেন, করোনা শুধুমাত্র বয়স্কদের জন্য মারাত্মক নয়, তরুণ-যুবকদের ক্ষেত্রেও এটা প্রাণঘাতী হতে পারে। 

এর কিছুদিন পর, অন্য একটি ডাচ পরিবারের আপন দুই ভাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো। তাদের দুজনেরই বয়স ছিলো আরো কম। মাত্র ২৩ এবং ২১ বছর। তারাও ছিলো দিব্যি সুস্থ এবং সবল। কিন্তু করোনা তাদেরকেও প্রচন্ড মাত্রায় কাবু করে ফেললো। ভেন্টিলেশনে দিতে হলো দু'জনকেই। প্রায় দুই সপ্তাহ মুমূর্ষ অবস্থায় থাকার পর চিকিৎসকদের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় দুই ভাই ফিরে এলো নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে। 

এই ঘটনা দুটো ডাচ চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুললো। তাঁরা এ দুটো ঘটনার মাঝে একটি মিল খুঁজে পেলেন। নেদারল্যান্ডসে এর আগে এত কম বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে করোনায় এত মারাত্মক অবস্থা হতে দেখা যায়নি। বোঝাই যাচ্ছে করোনার বিরুদ্ধে তাদের দেহের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যন্ত দুর্বল ছিল। কিন্তু দু'জোড়া সহোদর ভাইয়ের ক্ষেত্রে এরকম খারাপ অবস্থা কেন হলো? ব্যাপারটা নিশ্চয়ই কাকতালীয় নয়। 

তাহলে কি এর পেছনে কোন জন্মগত জেনেটিক কারণ রয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ডাচ চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা একটি বিশেষ জেনেটিক ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা করে দেখলেন। পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেল, তাদের চারজনের সবারই এক্স (X) ক্রোমোজোমের মধ্যে জন্মগত মিউটেশন রয়েছে। এই মিউটেশনটি হয়েছে TLR7 জিনে। ‌ এই জিনটি মানবদেহে Toll Like Receptor 7 নামে একটি বিশেষ ধরনের ইমিউনো প্রোটিন (immuno-protein) উৎপন্ন করে। এটি করোনা ভাইরাসকে ইন্টারফেরন নামক এক ধরনের সিগন্যাল প্রোটিনের মাধ্যমে চিহ্নিত করতে পারে। করোনা ভাইরাসকে চিহ্নিত করার পর এর বিরুদ্ধে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেম কার্যকর হয়। TLR7 প্রোটিনটি করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে কার্যকরী করার জন্য অপরিহার্য। 

ডাচ ভ্রাতাদের জিন পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা এখন বুঝতে পারছেন যাদের এক্স ক্রোমোজোমে TLR7 জিনে মিউটেশন জনিত সমস্যা রয়েছে, তারা করোনা ভাইরাসের কাছে খুবই অসহায়। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে তাদের শরীর স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারছে না। ফলে তারা মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মারাও যাচ্ছেন। 

এখানে বলে রাখি, পুরুষের কোষে একটি এক্স ক্রোমোজোম থাকলেও, নারীর কোষে এক্স ক্রোমোজোম রয়েছে দুইটি। সেজন্য অনেক বিজ্ঞানী ধারণা করছেন, দুটি এক্স ক্রোমোজোম থাকার কারণে নারীর ইমিউন সিস্টেমে TLR7 প্রোটিনের আধিক্য রয়েছে। এটি সম্ভবত নারীদেরকে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে পুরুষদের চেয়ে অধিকতর সুরক্ষা দিচ্ছে। 

কোন কোন ক্ষেত্রে নারীর একটি এক্স ক্রোমোজোমে TLR7 জিনে মিউটেশন থাকলেও অন্য এক্স ক্রোমোজোমটিতে এই জিনটি স্বাভাবিক অবস্থায় থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে একটি মিউটেশন থাকা সত্ত্বেও নারীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরী থাকবে। কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে TLR7 জিনে মিউটেশন হলে এটি সম্ভব নয়। কারণ পুরুষের এক্স ক্রোমোজোম রয়েছে মাত্র একটি। এজন্যই হয়তো পুরুষরা নারীদের চেয়ে কোভিড -১৯ রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। এই রোগে পুরুষদের মৃত্যুর হার ও নারীদের চেয়ে বেশি। 

TLR7 জিনের মিউটেশনের সাথে করোনা ভাইরাসের সম্পর্ক নিয়ে ডাচ চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক চাঞ্চল্যকর আবিষ্কারটি প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে একটি সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে পারে। গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ইন্টারফেরনের ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে এখন চিন্তাভাবনা চলছে। অদূর ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীরা কোভিড১৯ মহামারীকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারবেন, এটা আমরা আশা করতেই পারি।

Comments