ব্ল্যাকহোল, ওয়ার্মহোল এবং কোয়ান্টাম স্পেস-টাইম

বিজ্ঞানীদের চিন্তা ভাবনার ব্যাপ্তি মাঝে মাঝে অলীক কল্পনাকেও হার মানিয়ে দেয়। আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের কথাই ধরুন। আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুসারে মহাবিশ্বে স্থান (space) এবং কাল (time) একই সূত্রে গাঁথা। যদিও সাদাচোখে আমরা স্থান এবং কালকে আলাদা মনে করি। কিন্তু আইনস্টাইনের মতে প্রকৃতপক্ষে স্থান‌ এবং কালের যৌথ বুননেই মহাবিশ্বের অবকাঠামো গঠিত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন স্পেস-টাইম (space-time)

আইনস্টাইন বলেছেন, বস্তুর ভরের (mass) কারণে স্পেস-টাইমের মধ্যে এক ধরনের বক্রতার (curvature) সৃষ্টি হয়।‌ এই বক্রতাটিকেই আমরা মহাকর্ষ বল (gravitational force) হিসেবে দেখি। স্পেস-টাইমকে আমরা একটি রাবারের চাদরের সাথে তুলনা করতে পারি। এই চাদরের উপর আমরা যদি একটি সীসার বল রাখি, তাহলে বলটির ভরের জন্য এর চারপাশে রাবারের চাদরটি বাঁকা হয়ে যাবে। ঠিক তেমনিভাবেই সূর্যের ভরের জন্য তার চারপাশের স্পেস-টাইমের মধ্যে এক ধরনের বক্রতার সৃষ্টি হয়েছে। আর সেটিকে অনুসরণ করেই পৃথিবী সহ অন্যান্য গ্রহ সূর্যকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করছে। ঠিক একইভাবে সূর্যও প্রদক্ষিণ করছে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে ঘিরে। যে বস্তুর ভর যত বেশি হবে তার চারপাশে বক্রতার পরিমাণ ও তত বেশি হবে। সেজন্যই তার মহাকর্ষ বলও হবে তত বেশি। এভাবেই আইনস্টাইন তাঁর তত্ত্বে মহাকর্ষ বলের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এরকম যুগান্তকারী ধারণা আইনস্টাইনের আগে আর কারো মাথায় আসেনি। তাঁর আবিষ্কৃত সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব গত একশো বছরে বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ভুলভাবে প্রমাণিত হয়েছে। 

পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বে এমন কিছু চমকপ্রদ বস্তুর সন্ধান পেয়েছেন যেগুলো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীকেও হার মানায়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ব্ল্যাকহোল (blackhole) বা কৃষ্ণবিবর। ব্ল্যাকহোল এমন এক মহাজাগতিক বস্তু যার প্রবল মহাকর্ষ বলের প্রভাবে এর ভেতর থেকে আলোকরশ্মি সহ কোন ধরনের সিগন্যালই বের হতে পারে না। ব্ল্যাকহোলের ভেতরটি সম্পূর্ণ অন্ধকার। সেজন্য ব্ল্যাকহোলকে শনাক্ত করা অত্যন্ত কঠিন। একে শনাক্ত করতে হয় পরোক্ষভাবে। ব্ল্যাকহোলের কাছাকাছি একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকে যেটা একবার অতিক্রম করলে সেখান থেকে ফেরার আর কোনো উপায় থাকে না। এই সীমার ভিতরে যে কোনো বস্তুকেই ব্ল্যাকহোল গ্রাস করে নেয়। এই সীমারেখাটির নাম হলো ইভেন্ট হরাইজন (event horizon) বা ঘটনা-দিগন্ত। ব্ল্যাকহোলকে শনাক্ত করতে হয় ইভেন্ট হরাইজনের সীমানার বাইরে থেকে। গত বছর বিজ্ঞানীরা ইভেন্ট হরাইজনের বাইরে থেকে একটি ব্ল্যাকহোলের ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছেন।‌

এ প্রসঙ্গে আরেক জন বিজ্ঞানীর নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন। তাঁর নাম হলো কার্ল শোয়ার্জশীল্ড। তিনিও একজন জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী । তিনি আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ফিল্ড সমীকরণ সমাধান করে বস্তুর মহাকর্ষীয় ব্যাসার্ধ (gravitational radius) নির্ণয় করতে সক্ষম হন। সেজন্য কোন বস্তুর মহাকর্ষীয় ব্যাসার্ধকে বলা হয় শোয়ার্জশীল্ড ব্যাসার্ধ (Schwarzschild radius)। ব্ল্যাকহোলের শোয়ার্জচাশীল্ডের ব্যাসার্ধটি এর কেন্দ্র থেকে শুরু করে ইভেন্ট হরাইজন পর্যন্ত বিস্তৃত । 

যদিও ব্ল্যাকহোলের প্রাথমিক ধারণাটি অনেক পুরোনো, কিন্তু আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মাধ্যমে এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটি সুদৃঢ় হয়েছে। ‌বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরে স্পেস-টাইমের বক্রতাটি অসীম আকার ধারণ করেছে। এর নাম তারা দিয়েছেন সিঙ্গুলারিটি (singularity)। এখানে এসে স্থান এবং কাল একাকার হয়ে গেছে। সময় গেছে থেমে। আগেই বলেছি, সর্বগ্রাসী মহাকর্ষ বলের কারণে ব্ল্যাকহোল তার চারপাশের সবকিছুকে গ্রাস করে নেয়। পদার্থ বিজ্ঞানের স্বাভাবিক নিয়মগুলি এখানে খাটে না। তাই ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরে কি ঘটছে সেটা নিশ্চিত করা বলা কঠিন। কিন্তু তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানীরা থেমে নেই। ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরে এক রহস্যময় জগতের সন্ধান তারা দিয়েছেন। 

ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরীণ চরিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আপেক্ষিকতার পাশাপাশি তাঁরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আশ্রয় নিয়েছেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্স হলো পদার্থ বিজ্ঞানের আরেকটি শাখা। এর কাজ কারবার হলো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণাদের নিয়ে। বিশাল মহাবিশ্বের চরিত্র ব্যাখ্যা করতে গেলে যেমন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার প্রয়োজন হয়, তেমনি বস্তুর অভ্যন্তরের অতি ক্ষুদ্র কণাদের চরিত্র ব্যাখ্যা করতে হলে প্রয়োজন হয় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের। সেজন্য পদার্থবিজ্ঞানে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের গুরুত্ব আপেক্ষিকতার চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আবিষ্কর্তা হলেন, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। আইনস্টাইনের মতো তিনিও ছিলেন একজন জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী। 

কোয়ান্টাম মেকানিক্সে এনট্যান্ঙ্গেলমেন্ট (entanglement) বলে একটি ব্যাপার রয়েছে। সোজা বাংলায় এর মানে হলো, পরস্পর জড়িয়ে থাকা। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, প্রকৃতিতে দুটি বস্তুকণার উদ্ভব এমনভাবে হতে পারে, যেখানে একটি বস্তুকণার কোয়ান্টাম চরিত্র ব্যাখ্যা করলে অন্য বস্তু কণাটির কোয়ান্টাম চরিত্রও জানা যায়। যদিও আপাতদৃষ্টিতে দুটি বস্তুকণার মধ্যে সরাসরি কোন যোগাযোগ নেই। তাদের মধ্যে অনেক দূরত্বও রয়েছে। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য বন্ধনে কোয়ান্টাম জগতের একটি বস্তুকণা অন্য একটি দূরবর্তী বস্তুকণার সাথে জড়িয়ে থাকতে পারে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পরিভাষায় একে বলা হয় এনট্যান্ঙ্গেলমেন্ট। এটা অনেকটা ভুতুড়ে ব্যাপারের মত। এখানেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে পদার্থ বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মাবলীর পার্থক্য দেখা যায়।
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা এখন মনে করছেন দূরবর্তী বস্তুকণার পরস্পরের সাথে জড়িয়ে থাকার এই ব্যাপারটি দিয়ে ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরীণ চরিত্র ব্যাখ্যা করা যায়। 
তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানীদের মতে, ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরে স্পেস-টাইমের অসীম বক্রতাটি একটি অদৃশ্য সুড়ঙ্গের আকার ধারণ করেছে। শুধু তাই নয়, স্পেস-টাইমের এই সুড়ঙ্গের মাধ্যমে বিশাল মহাবিশ্বে একটি ব্ল্যাকহোল অন্য একটি ব্ল্যাকহোলের সাথে সংযুক্ত অবস্থায় থাকতে পারে। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে ব্ল্যাকহোল দুটো লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্পেস-টাইমের সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে তারা পরস্পরের সাথে সংযুক্ত অবস্থায় রয়েছে। স্পেস-টাইমের ভেতরের এই অদৃশ্য সুড়ঙ্গের নাম তাঁরা দিয়েছেন, ওয়ার্মহোল (wormhole)। 

ব্যাপারটা সাইন্স ফিকশনের মত মনে হলেও, ওয়ার্মহোলের ধারণাটি অবশ্য নতুন কিছু নয়। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যায়। আইনস্টাইন এবং তাঁর সহযোগী বিজ্ঞানী ন্যাথান রোজেন ১৯৩৫ সালে লেখা এক গবেষণা নিবন্ধে এর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তাঁরা অবশ্য তখন ওয়ার্মহোল নামটি ব্যবহার করেননি, বিজ্ঞানী মহলে তখন একে আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজ (Einstein-Rosen Bridge) নামে আখ্যায়িত করা হতো। 

বর্তমান যুগের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা ওয়ার্মহোলের ভেতরকার স্পেস-টাইমের চরিত্র নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। তাঁদের ধারণা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এনট্যান্ঙ্গেলমেন্টের ধারণাটি প্রয়োগ করেই ওয়ার্মহোলের ভেতরে স্পেস-টাইমের একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। তাদের মতে ওয়ার্মহোলের ভেতরে কোয়ান্টাম এনট্যান্ঙ্গেলমেন্টের ফলে স্পেস-টাইম সব একাকার হয়ে গেছে। সেজন্য একটি ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরের বস্তুকণার কোয়ান্টাম চরিত্র জানা গেলে সংযুক্ত অন্য ব্ল্যাকহোলটির অভ্যন্তরীণ বস্তুকণার চরিত্রও জানা যাবে। 

শুধুমাত্র ওয়ার্মহোলের ভেতরেই নয়, তাঁদের মতে, কোয়ান্টাম এনট্যান্ঙ্গেলমেন্টের ফলেই সম্ভবত মহাবিশ্বের সর্বত্রই স্পেস-টাইমের উৎপত্তি হয়েছে। এর নাম তারা দিয়েছেন, "কোয়ান্টাম স্পেস-টাইম"। একে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, কিন্তু গাণিতিক ভাবে প্রকাশ করা যায়। 

বিজ্ঞানীরা আশা করছেন "কোয়ান্টাম স্পেস-টাইম" এর রহস্যটি একদিন পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হবে। এটি প্রমাণিত হলে পদার্থবিজ্ঞানের দুটি প্রধান স্তম্ভ, আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপিত হবে। পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সেটি হবে একটি বিশাল মাইলফলক। 

তথ্যসূত্র: সাইন্টিফিক আমেরিকান, ওয়ান্ডার্স অফ দি কসমস, ফল ২০১৭।

Comments