ফার্মি প্যারাডক্স

নোবেল বিজয়ী, বিশ্ববিখ্যাত ইতালিয়ান-আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী, এনরিকো ফার্মি একবার মধ্যাহ্নভোজনের সময় কথাচ্ছলে তাঁর বিজ্ঞানী বন্ধুদের কাছে একটি হেঁয়ালি প্রশ্ন করেছিলেন, "তারা সবাই কোথায়"?

এটা ছিল ১৯৫০ সালের কথা। মানুষ তখন সবেমাত্র পরমাণু শক্তিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে লাগাতে শিখেছে। ‌প্রথম পারমাণবিক চুল্লি ছিল এনরিকো ফার্মিরই আবিষ্কার। পদার্থ বিজ্ঞানের গবেষণায় অসাধারণ অবদান রাখার জন্য তাঁর নামে প্রাথমিক বস্তুকণার নামকরণ করা হয়েছে ফার্মিয়ন। ‌ ফার্মি ছিলেন সে যুগের প্রথম সারির পদার্থ বিজ্ঞানীদের মধ্যে একজন। মহাকাশ নিয়ে তাঁর ছিল ব্যাপক জিজ্ঞাসা। 

আসলে এই প্রশ্নের মাধ্যমে ফার্মি বোঝাতে চেয়েছিলেন, এই বিশাল মহাবিশ্বে অসংখ্য উন্নত এলিয়েন সভ্যতার অস্তিত্ব থাকা খুবই স্বাভাবিক এবং সেই সব সভ্যতার অধিবাসীদের কাছে মহাশূন্যে ভ্রমণের অথবা দূরপাল্লার যোগাযোগের অনেক ধরনের উন্নত প্রযুক্তি থাকাটাও খুবই সম্ভব। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সেইসব এলিয়েনদের সাথে আমাদের এখনো কোন যোগাযোগই হয়নি। তারা আমাদের সাথে যোগাযোগের কোন চেষ্টাই করেনি। তাদের অস্তিত্ব নিয়ে আমরা এখনও নিশ্চিত নই। তারা কোথায় থাকে আমরা জানি না। এই বিস্ময়কর ব্যাপারটিই ছিল তাঁর প্রশ্নের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। তাঁর এই প্রশ্নটি বিজ্ঞানী মহলে "ফার্মি প্যারাডক্স" হিসেবে পরিচিত। 

বিজ্ঞানীরা ফার্মি প্যারাডক্সের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বিভিন্নভাবে। যেমন:
১) মহাবিশ্বে ভ্রমণ করার প্রধান অন্তরায় হলো দূরত্ব। ‌ অপরিসীম দূরত্বের কারণে এলিয়েনদের পক্ষে পৃথিবীতে ভ্রমণ করা সম্ভব হয়নি। 
২) এলিয়েনরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করার কোন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। 
৩) এলিয়েন সভ্যতা গুলো এখনো আদিম অবস্থায় রয়েছে। মহাশূন্যে ভ্রমণের মত প্রযুক্তি তাদের হাতে নেই। 
৪) আদিম যুগের পৃথিবীতে এলিয়েনরা এসেছিলো, কিন্তু বর্তমানের পৃথিবীকে তারা নানা কারণে এড়িয়ে চলেছে। 
৫) মহাবিশ্বে পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব নেই। ‌

মহাবিশ্বের আয়তন বিবেচনা করলে বিস্মিত হতে হয়। একমাত্র আমাদের গ্যালাক্সিতেই ৪০০ বিলিয়ন অথবা তার চেয়ে বেশি নক্ষত্র আছে। আর মহাবিশ্বে এরকম গ্যালাক্সি রয়েছে ১০০ বিলিয়নেরও বেশি। অতএব সেই হিসেবে ৪০ হাজার বিলিয়ন বিলিয়ন অথবা তারও বেশি নক্ষত্র রয়েছে মহাবিশ্বে। সাম্প্রতিক কালের গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি পাঁচটি নক্ষত্রের একটিতে পৃথিবীর মতো সাইজের গ্রহ থাকা সম্ভব। সেই হিসেবে আমাদের মহাবিশ্বে পৃথিবীর মতো কয়েক হাজার বিলিয়ন বিলিয়ন অথবা তার চেয়েও বেশি গ্রহ রয়েছে। এখন পর্যন্ত সৌরজগতের বাইরে হাজার তিনেকের মত গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে। ‌ ভবিষ্যতে সংখ্যাটা আরও বাড়বে সেটা বলাই বাহুল্য।  

পৃথিবীতে যদি প্রাণের উন্মেষ হতে পারে, তাহলে মহাবিশ্বের অসংখ্য গ্রহে প্রাণের উন্মেষ হওয়াটাও স্বাভাবিক। না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। আর সেই সব গ্রহে মানব সভ্যতার চেয়ে অনেক উন্নত সভ্যতার বিকাশ ঘটার সম্ভাবনাও  প্রচুর । সুতরাং পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব নেই, সেটা পরিসংখ্যানের ধোপে টেকে না। বিজ্ঞানীদের ধারণা কোন গ্রহে সভ্যতার বিকাশ হলে ৫ থেকে ১০ মিলিয়ন বছরের মধ্যে সেসব গ্রহের অধিবাসীরা তাদের নিজস্ব গ্যালাক্সির বিভিন্ন স্থানে কলোনি গড়ে তুলবে। মহাবিশ্বের বয়স বিবেচনা করলে এটা কোন বিশাল সময় নয়। তার মানে হলো, আমাদের গ্যালাক্সিতে ৫ থেকে ১০ মিলিয়ন বছর আগে কোন উন্নত সভ্যতার বিকাশ হয়ে থাকলে, এতদিনে তারা আমাদের গ্রহ পৃথিবীতে এসে হানা দিত। অথচ এরকম কোন নিদর্শন আমরা এখনো পাইনি। 

একদল বিজ্ঞানী মনে করেন, আমরা এলিয়েন সভ্যতাকে মানব সভ্যতার মাপকাঠিতে বিচার করছি। এমনও হতে পারে এলিয়েন সভ্যতা অত্যন্ত উদার সভ্যতা, যারা মানুষের মত হিংস্র নয়, তারা কলোনাইজেশনে বিশ্বাস করে না। তারা হয়তো অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে চায়না। সেজন্যই তাদের আমরা দেখতে পাই না। ‌

আরো একদল বিজ্ঞানী মনে করেন, কোন এলিয়েন সভ্যতা যখন উন্নতির চরম শিখরে ওঠে, তখন তারা মারামারি হানাহানি করে নিজেদেরকে ধ্বংস করে ফেলে। ‌ ফলে মহাবিশ্ব বিজয় করা তাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব হয়না। অথবা উন্নয়নের জোয়ারে ভাসতে গিয়ে তারা তাদের গ্রহের পরিবেশের এতোটাই ক্ষতি করে যে তার পরিণতিতে নিজেদের ধ্বংস নিজেরাই ডেকে আনে। সেজন্য তাদের দেখা আমরা কখনোই পাইনা। 

আসলে ফার্মি প্যারাডক্সের উত্তর কারোই জানা নেই। সবই হলো অনুমানভিত্তিক। এলিয়েনরা কি করছে বা করছে না সেটা আমাদের কখনোই জানা হবেনা। তবে আমাদের এই সুজলা-সুফলা সুন্দর পৃথিবীকে সভ্যতার নামে, উন্নয়নের নামে, আমরা যে তিলে তিলে ধ্বংস করে ফেলছি সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। ‌ভবিষ্যতে মানব সভ্যতাকে বাঁচাতে হলে অন্য কোনো গ্রহে গিয়ে মানুষের বসতি স্থাপন করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তখন মানুষই হয়ে উঠবে এলিয়েন। এটাও একটি বিশাল প্যারাডক্স।

Comments