ঢাকার অদূরে কালিয়াকৈরের কাছে শ্যাওড়াতলী নামে একটা গ্রাম আছে। সেই গ্রামে ১৮৯৩ সালে অসাধারণ একটি ছেলের জন্ম হয়েছিলো। ছেলেটির বাবা ছিল মুদির দোকানদার। তাদের ছিল অভাবের সংসার। ছেলেটি যখন একটু বড় হলো বাবা তাকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। কিন্তু লেখাপড়ার পাশাপাশি তাকে বাবার মুদির দোকানেও সাহায্য করতে হতো। দিনের বেলায় তার পড়াশোনা করার তেমন সুযোগ হতো না। সেজন্য গভীর রাত পর্যন্ত কুপি জ্বালিয়ে ছেলেটি পড়াশোনা করতো। ছেলেটি ছিল অসম্ভব মেধাবী। অংকে তার মাথা ছিল পরিষ্কার। কিন্তু গ্রামের স্কুলে ক্লাস থ্রির বেশি পড়াশোনা করার সুযোগ তার ছিল না। সেজন্য বাবা তাকে দশ মাইল দূরে শিমুলিয়ায় একটি মিডল স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। সেখানে একজন চিকিৎসকের বাড়িতে থেকে ছেলেটি পড়াশোনা করতো। বিনিময়ে তাকে বাড়ির যাবতীয় কাজ, যেমন বাসন কোসন মাজা থেকে শুরু করে গরু বাছুর পালা সবই করতে হতো। কিন্তু ছেলেটির অধ্যবসায়ের কোন অভাব ছিল না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মেধাবী সেই ছেলেটি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ঢাকা বিভাগে প্রথম হয়ে গেল। তারপর সরকারি বৃত্তি নিয়ে ঢাকা শহরে এসে সে ভর্তি হলো কলেজিয়েট স্কুলে।
ছেলেটির নাম মেঘনাদ সাহা। ঢাকায় এসে ছেলেটি পড়াশোনার পাশাপাশি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লো। ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ছেলেটি জড়িয়ে পড়ল স্বদেশী আন্দোলনে। এর ফলে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে সে বহিস্কৃত হলো। তার সরকারি বৃত্তিও বাতিল হয়ে গেল। ছেলেটি পড়লো মহা বিপদে। কিন্তু তার বিপদে এগিয়ে এলেন একজন শিক্ষক। তাঁর সহায়তায় মেঘনাদ সাহা ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করলেন।
এরপর কলকাতায় এসে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন তিনি। এখানে সহপাঠী হিসেবে পেলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। পরবর্তীতে মেঘনাদ সাহা এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু যৌথভাবে এম এস সি পরীক্ষাতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন। তারপর তাঁরা দুজনেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। কয়েক বছর পর মেঘনাদ সাহা একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। আর সত্যেন্দ্রনাথ বসু কলকাতা ছেড়ে নব্য স্থাপিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেন।
ডক্টর মেঘনাদ সাহা ফলিত গণিতের ছাত্র হলেও জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে মৌলিক গবেষণা করে জগৎ বিখ্যাত হয়েছিলেন। সে সময়ের বিজ্ঞানীরা নক্ষত্রের ভৌত রাসায়নিক গঠন নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ১৯২০ সালে মেঘনাদ সাহাই সর্বপ্রথম তাঁর উদ্ভাবিত থার্মাল আয়োনাইজেশন সমীকরণের সাহায্যে নক্ষত্রের পারমাণবিক গঠনের ব্যাখ্যা দেন। সৌররশ্মির তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করে তাঁর সমীকরণের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে সূর্য মূলত হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম দিয়ে তৈরি। সূর্যের মধ্যে ভারী মৌলের পরিমান অতি সামান্য। অনান্য নক্ষত্রের ক্ষেত্রেও তাঁর সমীকরণ প্রয়োগ করে তাদের ভৌত রাসায়নিক গঠন সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে "সাহা সমীকরণ" একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর অমূল্য অবদানের জন্য মেঘনাদ সাহা ১৯২৭ সালে ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটির ফেলো (FRS) নির্বাচিত হন।
মেঘনাদ সাহাকে নোবেল প্রাইজ দেওয়ার জন্য একাধিকবার প্রস্তাব করা সত্ত্বেও নোবেল পুরস্কার থেকে তাকে প্রতিবারই বঞ্চিত করা হয়েছিলো। সম্ভবত সে সময় পরাধীন দেশের নাগরিক হবার কারণেই তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি। একইভাবে সত্যেন্দ্রনাথ বসুকেও নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিলো।
পরবর্তী জীবনে মেঘনাদ সাহা এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি কলকাতায় ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স স্থাপন করেছিলেন, যা পরবর্তীতে সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। অধ্যাপনা ও গবেষণার পাশাপাশি তিনি ছিলেন রাজনীতিতেও সক্রিয়। ভারতীয় লোকসভায় সদস্য হিসেবে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি জানতেন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কোন দেশে বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এজন্যই তিনি রাজনীতিতে পদার্পণ করেছিলেন। ভারতীয় প্ল্যানিং কমিশনের একজন সদস্য হিসাবেও মৌলিক বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৫৬ সালে এই ক্ষণজন্মা বিজ্ঞানীর জীবনাবসান হয়। নক্ষত্রের মতোই উজ্জ্বল ছিল তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি।
বিংশ শতাব্দীতে আমাদের উপমহাদেশের বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী তাঁদের অনন্য অবদানের জন্য বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁদের অনেকেরই জন্ম হয়েছিলো আমাদের বাংলাদেশে। অথচ বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এখন তাঁদের কথা জানেনা। আমাদের তরুণ সমাজকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলতে হলে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁদের অবদানের কথা জানাটা খুবই প্রয়োজন।
Comments