প্ল্যান্ট ব্রীডার্স রাইটস (পি বি আর)

প্ল্যান্ট ব্রিডিং বা উদ্ভিদ প্রজনন একটি সময় সাপেক্ষ ও ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। একটি নুতন জাতের গাছ উদ্ভাবন করতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়। যেমন ধরুন নুতন জাতের একটি ধান উদ্ভাবন করে সেটা বাজারে ছাড়তে কোনো কোন ক্ষেত্রে দশ থেকে বারো বছর লেগে যায়। ফল গাছের ক্ষেত্রে এটা আরো বেশিও হতে পারে। সময় ছাড়াও বিপুল পরিমান অর্থও ব্যয় করতে হয় এ ব্যাপারে গবেষণা করার জন্য। কিন্তু এই বিপুল বিনিয়োগ  করে নুতন জাতটি বাজারে ছাড়ার পর এর থেকে সরাসরি রয়্যালটি পাবার কোনো উপায় আছে কি?

একজন লেখক যদি তাঁর লেখা বইয়ের কপিরাইট থেকে রয়্যালটি পেতে পারেন তাহলে একজন প্ল্যান্ট ব্রীডার কেন তাঁর উদ্ভাবিত নুতন জাতের উদ্ভিদ থেকে কোনো রয়্যালটি পাবেন না?

এই প্রশ্ন থেকে ১৯৬১ সনে ইউরোপে  সর্বপ্রথম প্ল্যান্ট ব্রীডার্স রাইটস বা পি বি আর (PBR) ধারণাটার প্রচলন হয়েছে। ইউরোপের দেশ গুলোতে প্রচলিত প্যাটেন্ট আইন অনুসারে গাছপালার উপর প্যাটেন্ট নেওয়া যায়না। সেই জন্য তারা পদক্ষেপ নিয়েছিলো উদ্ভিদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ এক নুতন ধরনের (sui generis) মেধাস্বত্ব (intellectual property) পদ্ধতি চালু করার। যাকে সংক্ষেপে বলে পি বি আর।

এর সাথে কপিরাইটের মিলই বেশি। যেমন ধরুন নিজের লেখা বইয়ের উপর লেখকের  মেধাস্বত্ব থাকলেও এতে ব্যবহৃত একক বর্ণ বা শব্দের উপর লেখকের কোনো অধিকার নেই।  একই ভাবে নুতন জাতের গাছের উপর ব্রীডারের বাণিজ্যিক  দাবি থাকলেও  এতে যে জিন বা জেনোটাইপ রয়েছে তার উপর ব্রীডারের কোনো মেধাস্বত্ব থাকেনা। অন্য কেউ চাইলে এসব জাত থেকে আরো নুতন জাতের উদ্ভিদ উদ্ভাবন করতে পারবেন। মূলত উদ্ভিদ প্রজননকে উৎসাহিত করার জন্যই পি বি আর ব্যবস্থাটির প্রচলন করা হয়েছে।  বর্তমানে বিশ্বের আশিটিরও বেশি দেশে এই ব্যবস্থাটি চালু রয়েছে। যে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি পি বি আরের ব্যাপারটা দেখাশুনা করে তার নাম হলো international union for the protection of new varieties of plants, ফরাসিতে এর সংক্ষিপ্ত নাম হলো UPOV। এর সদর দপ্তর জেনেভায় অবস্থিত।

পি বি আর প্রথম শর্ত  হলো
নতুন জাতটি উদ্ভাবনের পেছনে উদ্ভিদ প্রজননের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া থাকতে হবে। ‌জাতটিকে হতে হবে সম্পূর্ণ একটি নুতন জাত। অর্থাৎ যেসব পুরানো জাত বাজারে পাওয়া যায় অথবা সকল ধরনের দেশী জাত, যেগুলো যুগ যুগ ধরে চাষাবাদ হচ্ছে সেগুলো পি বি আরের আওতায় আসেনা। সাধারনত নুতন জাতটি বাজারজাত করার এক বছরের মধ্যেই পি বি আরের জন্য আবেদন করতে হয়। তবে এর আগেও করা যায়।

পরবর্তী শর্তগুলো কিছুটা  টেকনিক্যাল ধরনের। যেমন :

১) নুতন জাতটিকে অন্যসব জাত থেকে হতে হবে স্বতন্ত্র ( Distinct)।  অর্থাৎ এর এমন কোনো বৈশিষ্ট্য  থাকতে হবে যা দিয়ে সহজেই জাতটিকে আলাদা করা যায় ।  এবং

২)  জাতটিকে হতে হবে অভিন্ন (Uniform)। এর  মধ্যে  অন্য কোন বৈশিষ্ট্যের গাছ থাকা চলবেনা। এবং

৩) সর্বোপরি জাতটিকে হতে হবে স্থিতিশীল ( stable)। অর্থাৎ বছরের পর বছর চাষাবাদ করলেও এর যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য  রয়েছে তার কোনো পরিবর্তন হলে চলবে না। এর বংশ পরম্পরা অক্ষুন্ন থাকতে হবে ।

এই তিনটি নির্ণায়ক (criteria) এর  ইংরেজি আদ্যক্ষর  অনুসারে সংক্ষেপে একে বলে ডাস  (DUS)। পি বি আর লাভের জন্য প্রতিটি নুতন জাতকে ডাস পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় ।

ডাস পরীক্ষার জন্য নুতন জাতটিকে অন্যান্য জাতের সাথে তুলনা করে দেখা হয়।  এতে নুতন জাতটির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য  থাকলে সেটা সহজেই  দেখা  যায়। এর পর জাতটিকে  পরীক্ষা করা  হয় এর অভিন্নতা ও স্হিতিশীলতা পর্যবেক্ষণ করার জন্য । এসব  পরীক্ষায় পাশ করলে জাতটিকে পি বি আর দেয়া  যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের জন্য আলাদা আলাদা ডাস প্রোটোকল রয়েছে ।

পি বি আর সাধারণত কুড়ি বছরের   জন্য দেয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে ব্রীডার তাঁর উদ্ভাবিত জাতের জন্য রয়্যালটি দাবি করতে পারবেন । কিন্তু কোন কৃষক যদি তাঁর নিজের ব্যবহারের জন্য জাতটির বীজ রেখে দেন সেক্ষেত্রে ব্রীডার কোনো দাবি করতে পারেন না।
তবে বানিজ্যিক ভিত্তিতে জাতটির বীজ উৎপাদন এবং বিক্রয় করতে হলে ব্রিডারের অনুমতি নিতে হবে।

বাংলাদেশের ব্রিডাররা ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে
অনেক এগিয়ে আছেন। দেশের অর্থনীতিতে তাঁদের অপরিসীম অবদান রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তাঁদের সাফল্যের সঠিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। ‌ বাংলাদেশে পিবিআর আইন চালু হলে, প্ল্যান্ট ব্রিডাররা তাঁদের মেধাস্বত্ব রক্ষা করার আইনগত ভিত্তি পাবেন।

Comments