আইনস্টাইনের ভুল?

আলবার্ট আইনস্টাইন ছিলেন একজন অসাধারণ প্রতিভাবান বিজ্ঞানী। অনেকের মতে তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বসেরা বিজ্ঞানী। গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে (১৯১৬) তাঁর আবিষ্কৃত জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

তিনি তাঁর তত্ত্বে স্থান, কাল এবং বস্তুকে  (স্পেস, টাইম এবং ম্যাটার ) এক সম্পূর্ণ নুতন দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বললেন, যদিও স্থান এবং কালকে আমরা আলাদা মনে করি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মহাবিশ্বে স্থান এবং কাল একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে  জড়িত। স্থান এবং কালের যৌথ বুননেই মহাবিশ্বের অবকাঠামো গঠিত হয়েছে। যখন কোনো বস্তু এর মধ্য দিয়ে ছুটে চলে তখন স্থান-কালের  বুননের মধ্যে এক ধরনের বক্রতার সৃষ্টি হয়। যে বস্তু যত বেশি ভারী তার চারপাশে বক্রতার পরিমান ও তত বেশি।  এই বক্রতার মাঝে  বস্তুর  ছুটে  চলায় স্থান -কালের চাদরে  একধরনের কম্পনের সৃষ্টি হয়, যা তরঙ্গের আকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

এটাকেই বিজ্ঞানীরা বলেন মহাকর্ষ তরঙ্গ। যে বস্তু যত ভারী তার মহাকর্ষ তরঙ্গ ও তত বেশি শক্তিশালী। কিন্তু তা সত্বেও মহাকর্ষ তরঙ্গকে সনাক্ত করা সহজ নয়। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা খুবই ক্ষীণ এবং পৃথিবী থেকে সনাক্ত করা অত্যন্ত কঠিন ।

এক শতাব্দি পর সেই কঠিন কাজটিই করেছেন বর্তমান যুগের
বিজ্ঞানীরা । ২০১৬ সালে একদল বিজ্ঞানীর একটি যুগান্তকারী আবিস্কার  সারা পৃথিবীব্যাপী ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করেছিলো। সে বছর প্রথমবারের মত বিজ্ঞানীরা গ্র্যাভিটেশানাল ওয়েভ বা মহাকর্ষ তরঙ্গের সন্ধান পেয়েছেন এক যুগান্তকারী পরীক্ষার মাধ্যমে। এই পরীক্ষার সাথে জড়িত ছিলেন একহাজারের ও বেশি বিজ্ঞানী। এদের মধ্যে দুজন  বাংলাদেশী বিজ্ঞানী ও রয়েছেন। দুটো বিশাল আকৃতির ব্ল্যাক হোলের সংঘর্ষ থেকে  উদ্ভুত মহাকর্ষ তরঙ্গের সন্ধান বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন তাদের লেজার ইন্টারফেরোমিটারে । কিন্তু  এই আবিস্কারটির জন্য মানুষকে অপেক্ষা করতে হয়েছে পুরো একটি শতাব্দী। আর সেই সাথে তাঁরা আবারো প্রমাণ করেছেন মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের তত্ত্বকে ।

তাহলে আইনস্টাইন ভুলটা করেছিলেন কোথায়?  আসলে ব্যাপারটা  হলো আইনস্টাইন যখন তাঁর জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি প্রকাশ করেছিলেন তখনও বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল  মহাবিশ্ব চিরকাল স্থির অবস্থায় রয়েছে । মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব বা বিগ ব্যাং থিওরি তখন ও আবিষ্কৃত হয়নি। তখনকার সমসাময়িক মহাজাগতিক বিজ্ঞানের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য আইনষ্টাইনকে তাঁর ফিল্ড সমীকরণে একটি ধ্রুবকের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। এর নাম তিনি দিয়েছিলেন কসমোলোজিক্যাল কনস্ট্যান্ট। গ্রিক অক্ষর ল্যামডা দিয়ে এই কসমোলোজিক্যাল কনস্ট্যান্টকে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন।

কিন্তু পরবর্তীকালে নানা পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হলো মহাবিশ্ব মোটেই স্থির নয়, এর পরিধি ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। তখন আইনস্টাইন তাঁর সমীকরণ থেকে কসমোলোজিক্যাল কনস্ট্যান্টকে বা ল্যামডাকে বাদ দেন। তিনি তখন এটাও স্বীকার করেন যে এটাই ছিল তাঁর বিজ্ঞানী জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল। আইনষ্টাইন মহা বিজ্ঞানী হলেও মানুষ ছিলেন। আর মানুষ মাত্রই ভুল করতে পারে।

কিন্তু আসলেই কি আইনস্টাইনের থিওরিতে কসমোলোজিক্যাল কনস্ট্যান্টকে অন্তর্ভুক্ত করাটা ভুল ছিল? নাকি পরে একে বাদ দেয়াটা ভুল ছিল এনিয়ে এখন বিজ্ঞানী মহলে প্রশ্ন উঠেছে।

এর কারণ হলো বর্তমানে মহাবিশ্বে ডার্ক এনার্জি নামে এক  রহস্যময় অদৃশ্য শক্তির  অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ব্যাপারটি একটু খুলেই বলি। বিজ্ঞানীরা মনে করেন ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে এক মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং এর ফলে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল । এরপর থেকে মহাবিশ্ব  ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে । নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ধারণা করা হতো যে মহাবিশ্বের প্রসারণ এক সময় থেমে যাবে এবং মহাকর্ষের কারণে  সংকুচিত হওয়া শুরু করবে মহাবিশ্ব। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে কিছু গবেষনা ও পর্যবেক্ষণের ফলে এটা এখন প্রমানিত হয়েছে যে, মহাবিশ্ব শুধু প্রসারিতই  হচ্ছেনা, বরং এর প্রসারণের গতি ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে।  মহাবিশ্বের এই  তরান্বিত  প্রসারণের ব্যাখ্যা দেওয়া খুবই কঠিন কাজ।  অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় কোনো এক অদৃশ্য শক্তি এর পেছনে কাজ করছে।  এই অদৃশ্য শক্তিকেই বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ডার্ক এনার্জি।

বিজ্ঞানীরা বলছেন মহাবিশ্বের শতকরা ৬৮ ভাগই  হচ্ছে ডার্ক এনার্জি। মহাশূন্যের সর্বত্র এর সুষম অবস্থান। অন্যভাবে  বলতে হয়, প্রকৃতপক্ষে এটি মহাশূন্যেরই একটি বৈশিষ্ট্য। মহাশূন্য আসলে শুন্য নয়, এর সর্বত্রই রয়েছে ডার্ক এনার্জি, যা ক্রমাগত গ্যালাক্সি গুলোকে দুর থেকে দুরে ঠেলে দিচ্ছে।  এক কথায় মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করছে এই ডার্ক এনার্জি।

বছর দুয়েক আগে দুজন ফরাসি বিজ্ঞানীর একটি  প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বখ্যাত নেচার পত্রিকায়। তাঁরা মৌলিক গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন আইনস্টাইনের সেই
কসমোলজিক্যাল কন্সট্যান্টের মাধ্যমেই ডার্ক এনার্জির সবচেয়ে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব। 

বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা তাই মনে করছেন আইনস্টাইন তাঁর সমীকরণে প্রথমে কসমোলজিক্যাল কন্সট্যান্টকে অন্তর্ভুক্ত করে আসলে ভুল করেন নি।

http://hubblesite.org/hubble_discoveries/dark_energy/de-did_einstein_predict.php

Comments