১৯৫৩ সালের ২৫ এপ্রিল। বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। এই দিনে বিশ্বখ্যাত নেইচার জার্নালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি এন এ গবেষক জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিকের যুগান্তকারী গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছিলো। এই গবেষণাপত্রটিতে তাঁরা সর্বপ্রথম ডি এন এর ভৌত কাঠামোর বর্ণনা দিয়েছিলেন। তাঁদের এই আবিষ্কারটি "ডি এন এ ডাবল হিলিক্স" (DNA double helix) নামে সারাবিশ্বে এখন সুপরিচিত। এই আবিষ্কারটির ফলে ডি এন এ গবেষণায় এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিলো। সেজন্য প্রতিবছর ২৫ এপ্রিল "ডি এন এ দিবস" (DNA day) হিসেবে উদযাপন করা হয়। কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা তাঁদের এই যুগান্তকারী আবিষ্কারটির পেছনে ভূমিকা রেখেছিলেন একজন প্রতিভাময়ী বিজ্ঞানী। আজ তাঁর কথাই বলবো।
ডি এন এ হলো ডি অক্সি রাইবো নিউক্লিক এসিডের সংক্ষিপ্ত নাম। জীবকোষের ক্রোমোজোমের মধ্যেই মূলত এর অবস্থান। ডি এন এ অণুতে ডি অক্সি রাইবোজ সুগারের সাথে যুক্ত থাকে ফসফেট গ্রুপ। আর থাকে চার ধরনের নাইট্রোজেন বেইস। এদের নাম হলো অ্যাডেনিন (A), থায়ামিন (T), সাইটোসিন (C) এবং গুয়ানিন (G)। সে যুগের বিজ্ঞানীরা ডি এন এর রাসায়নিক উপাদানগুলি চিহ্নিত করতে পারলেও এর আণবিক গঠন সম্বন্ধে নিশ্চিত ছিলেন না।
তবে তখনকার বিজ্ঞানীরা এটা জানতেন ডি এন এ হলো বংশগতির ধারক এবং বাহক। কিন্তু ডি এন এ অণু ঠিক কিভাবে বংশগতিকে ধারণ এবং বহন করে সে সম্বন্ধে তাঁদের সম্যক কোন ধারণা ছিল না। কিন্তু তাঁরা এটা বুঝতে পেরেছিলেন, ডি এন এর কার্যপ্রণালী ব্যাখ্যা করতে হলে সর্বপ্রথম এর আণবিক গঠনটি জানা প্রয়োজন।
সেই সময় লন্ডনের কিংস কলেজে রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন নামে একজন মহিলা গবেষক তিন বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে কাজ করছিলেন। তাঁর বয়স ছিল তিরিশের কাছাকাছি। রোজালিন্ড একজন রসায়নবিদ হলেও কাজ করতেন এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফি (X- ray crystallography) নিয়ে। এক্সরে যখন কোন ক্রিস্টালের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন তার বিচ্ছুরণের প্যাটার্ন থেকে সেই ক্রিস্টালটির আণবিক গঠন সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। এই প্রযুক্তিকে বলা হয় এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফি। রোজালিন্ড ছিলেন এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফিতে অত্যন্ত দক্ষ। এ ব্যাপারে তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল।
তিনি কিংস কলেজে থাকাকালীন সময়ে এই প্রযুক্তিটির সাহায্যে ডি এন এর আণবিক গঠন সম্বন্ধে জানার চেষ্টা করছিলেন। ডি এন এ ফাইবারকে ক্রিস্টালে পরিণত করে তিনি এক্সরের সাহায্যে অনেক ছবি তুলেছিলেন। এর মধ্যে বেশিরভাগ ছবিই ছিল অস্পষ্ট। বলাই বাহুল্য সে সময়ের প্রযুক্তি এখনকার মত এত উন্নত ছিল না। তাছাড়া ডি এন এ অণুর ছবি তোলা ছিল এক দুরহ ব্যাপার। কিন্তু তারপরও তিনি একটি ছবি তুলতে পেরেছিলেন যা ছিল নজিরবিহীন। সেই ছবিটিকে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন "প্লেট ফিফটি ওয়ান" হিসেবে।
এই ছবিটিতে ডি এন এর অবকাঠামোটি খুব ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এ নিয়ে রোজালিন্ড তাঁর গবেষণা বেশি দূর এগিয়ে নিতে পারেননি। সে সময় তাঁর চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়াতে তিনি কিংস কলেজ ছেড়ে চলে আসেন। যাওয়ার আগে তিনি তাঁর তোলা ডি এন এ অণুর সেই অসাধারণ ছবিটি সহকর্মী মরিস উইলকিন্সকে দিয়ে গিয়েছিলেন। মরিস মূলত ছিলেন একজন পদার্থবিদ। তিনিও ডি এন এ ক্রিস্টালোগ্রাফি নিয়ে কাজ করছিলেন। মরিস উইলকিন্স প্লেট ফিফটি ওয়ান ছবিটি হাতে পাবার পর এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারলেন।
তিনি তখন কেমব্রিজের গবেষক জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিকের শরণাপন্ন হলেন। তাঁদেরকে ছবিটি দেখালেন। জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক দুজনেই ডি এন এর গঠন নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই গবেষণা করছিলেন। গবেষণায় অনেক ডাটা তাঁরা সংগ্রহ করেছিলেন। রোজালিন্ডের তোলা ডি এন এর ছবিটি হাতে পেয়ে তাঁরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। তাঁদের গবেষণার ডাটা ছবিটির সাথে হুবহু মিলে গেল। তাঁরা ছবিটি দেখে বুঝতে পারলেন দুটো লম্বা সুতোর মতো ডি এ এন অণু পরস্পরকে জড়িয়ে রয়েছে। এই জড়িয়ে থাকা কাঠামোটির নাম তাঁরা দিয়েছিলেন "ডি এন এ ডাবল হিলিক্স"। তাঁরা আরো বললেন, এই ডাবল হিলিক্স কাঠামোর ভেতরের দিকে অ্যাডেনিন জোড় বেঁধে থাকে থাইমিনের সাথে, আর সাইটোসিন জোড় বেঁধে থাকে গুয়ানিনের সাথে। ফসফেট গ্রুপটি থাকে বাইরের দিকে যার মাধ্যমে ডি অক্সি রাইবোজ সুগারগুলো পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকে। ডি এন এর সহজ সুন্দর একটি মডেল তাঁরা আবিষ্কার করলেন, যার মূলে ছিল রোজালিন্ডের তোলা সেই অসাধারণ এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফটি।
তাঁদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশ হবার পর ডি এন এ গবেষণার এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো। ডি এন এ ডাবল হিলিক্স কাঠামোটি থেকে অনুরূপ আরেকটি ডি এন এ অণু কি ভাবে তৈরি হয় সেটাও বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করতে পারলেন। একে বলে ডি এন এ রেপ্লিকেশন প্রক্রিয়া। সর্বোপরি ওই চারটি নাইট্রোজেন বেইসের বিন্যাসে জেনেটিক কোড কিভাবে রচিত হয় সেটাও বিজ্ঞানীরা কয়েক বছরের মধ্যেই আবিষ্কার করে ফেললেন। তারপর ধীরে ধীরে এলো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জিনোম সিকোয়েন্সিং, জিন থেরাপি এবং জিন এডিটিং এর যুগ। এসব কিছুরই সূচনা হয়েছিলো ডি এন এ ডাবল হিলিক্স কাঠামোটির উপর ভিত্তি করে। এজন্যই জেনেটিক্সে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
১৯৬২ সালে জেমস ওয়াটসন, ফ্রান্সিস ক্রিক এবং মরিস উইলকিন্সকে ডি এন এর গঠন আবিষ্কারের জন্য যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু বাদ পড়ে যান রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন। এখানে বলে রাখি, জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক তাঁদের প্রকাশিত গবেষণাপত্রে মরিস উইলকিন্স এবং রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন উভয়ের অপ্রকাশিত কাজের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত ১৯৫৮ সালে রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পরলোকে গমন করেন। সম্ভবত এক্স রে নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করার ফলেই তাকে অল্প বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে হয়েছিলো। ধারণা করা হয়, মরণোত্তর নোবেল পুরস্কার দেয়ার বিধান না থাকায় রোজালিন্ডকে পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা হয়নি।
রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন ছিলেন একজন অসাধারণ প্রতিভাময়ী বিজ্ঞানী। ডি এন এর পাশাপাশি তিনি আর এন এ (RNA) নিয়েও গবেষণা করেছিলেন। তিনিই প্রথম প্রমাণ করেছিলেন আর এন এ একটি সিঙ্গেল স্ট্রান্ডের অণু। এছাড়া টোবাকো মোজাইক ভাইরাস (TMV) নিয়েও তিনি প্রচুর গবেষণা করেছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ডি এন এর সেই অসাধারণ ছবিটি যেটি দেখে জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক ডি এন এ ডাবল হিলিক্স কাঠামোর ব্যাপারে তাঁদের সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছিলেন। রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন ছিলেন ডাবল হিলিক্সের নেপথ্যের নায়িকা, যার নাম এখন আমরা অনেকেই ভুলে গেছি।
Comments