হরগোবিন্দ খোরানার জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত ভারতে। পাঞ্জাবের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তাঁর বাবা ছোটখাটো একটি চাকরি করতেন। অভাবের সংসার। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। কিন্তু তাঁর বাবা শিক্ষার মূল্য বুঝতেন। তিনি জানতেন শিক্ষাই মানুষের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। সেজন্য তিনি তাঁর সব সন্তানকেই স্কুলে পাঠিয়েছিলেন।
হরগোবিন্দের শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের পাঠশালায়। গাছ তলায় বসে ক্লাস করতেন। ছোটবেলা থেকেই হরগোবিন্দ লেখাপড়ায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। পাঠশালা শেষ করে, স্কুল কলেজের চৌকাঠ পেরিয়ে তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। তাঁর বিষয় হল রসায়ন। হরগোবিন্দ রসায়নের মধ্যেই রসের সন্ধান পেলেন। মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হলেন। মিললো বিলেতে পিএইচডি করার স্কলারশিপ। জীবনের মোড় ঘুরে গেল হরগোবিন্দের।
এটা ১৯৪৫ সালের কথা। হরগোবিন্দ জৈব রসায়নে পিএইচডি করতে ইংল্যান্ডে আসলেন। উচ্চতর গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত হলেন তিনি।
১৯৪৮ সালে পিএইচডি শেষ করে আবার দেশে ফিরে গেলেন। ভারত তখন ভাগ হয়ে গেছে। পাঞ্জাব ও ভাগ হয়ে গেছে। হরগোবিন্দের ইচ্ছে ছিল দেশে ফিরে রসায়নে আরো গবেষণা করার। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে তিনি দেশে কোথাও গবেষণা করার সুযোগ পেলেন না। তিনি ইউরোপে চলে গেলেন পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করার জন্য।
১৯৫২ সনে হরগোবিন্দ কানাডার ভ্যাঙ্কুভারের একটি গবেষণাগারে কিছু মৌলিক কাজ করার সুযোগ পেলেন। এবার তিনি জৈব রসায়ন থেকে প্রাণ রসায়নের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু হলো নিউক্লিক অ্যাসিড এবং প্রোটিন।
পঞ্চাশের দশকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছিলো।তখনকার বিজ্ঞানীরা জানতেন প্রাণের প্রধান উপাদান হলো একটি নিউক্লিক অ্যাসিড, যার নাম হল ডি-অক্সি রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড বা সংক্ষেপে ডিএনএ (DNA)। কিন্তু ডিএনএ অণুর গঠন প্রণালী নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে নানা ধরনের মতপার্থক্য ছিল। ১৯৫৩ সালে জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক নামে দুজন বিজ্ঞানী সফলভাবে ডিএনএ অণুর গঠন প্রণালী ব্যাখ্যা করলেন। তাঁরা প্রমাণ করলেন ডিএনএ অণুগুলো দুটো লম্বা সুতোর মতো পরস্পরকে জড়িয়ে থাকে। এই জড়িয়ে থাকা কাঠামোটির নাম হলো ডিএনএ ডাবল হিলিক্স। এই কাঠামোটি তৈরী হয়েছে ডি-অক্সি রাইবোস সুগার, ফসফেট এবং চার ধরণের নাইট্রোজেন বেইস (base) দিয়ে। একত্রে এদেরকে বলে নিউক্লিওটাইড।
নিউক্লিওটাইডের নাইট্রোজেন বেইসগুলোকে তাদের নামের চারটি আদ্যক্ষর, ATGC দিয়ে প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন যে এই চারটি অক্ষরের মধ্যেই ডিএনএর জেনেটিক কোডের যাবতীয় তথ্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু জেনেটিক কোডের মূলরহস্য তখনও বিজ্ঞানীদের কাছে অজানা।
১৯৬০ সালে হরগোবিন্দ খোরানা ক্যানাডা থেকে আমেরিকায় চলে আসলেন। ইউনিভার্সিটি অফ উইসকনসিনে তিনি ডিএনএ এবং প্রোটিন নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন।
তিনি দেখলেন ডিএনএ থেকে প্রোটিন তৈরির প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়। ডিএনএ থেকে প্রথমে তৈরি হয় মেসেঞ্জার আরএনএ (mRNA)। তারপর মেসেঞ্জার আরএনএ থেকে ট্রান্সফার আরএনএ র (tRNA) মাধ্যমে প্রোটিন তৈরি হয়। প্রোটিনের মূল উপাদান হলো কুড়িটি অ্যামাইনো এসিড। এই কুড়িটি অ্যামাইনো এসিডকে চিহ্নিত করার জন্য মেসেঞ্জার আরএনএ র মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন কোড রয়েছে। এদেরকে বলা হয় কোডন (Codon)। একটি কোডনের জন্য দরকার হয় তিনটি নাইট্রোজেন বেইস। অথচ নাইট্রোজেন বেইস রয়েছে মোট চারটি। এই চারটি নাইট্রোজেন বেইস দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কম্বিনেশনে মোট ৬৪ টি কোডন তৈরি করা সম্ভব।
১৯৬১ সনে এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম গবেষণা শুরু করেছিলেন মার্শাল নিরেনবার্গ। তিনি প্রাথমিকভাবে কয়েকটি কোডনকে চিহ্নিত করলেন। কিন্তু তখনও সবকয়টি কোডনকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। হরগোবিন্দ খোরানা এ ব্যাপারে ব্যাপক গবেষণা শুরু করলেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি তাঁর গবেষণার মাধ্যমে একে একে চৌষট্টিটি কোডনকেই সনাক্ত করতে সক্ষম হন। এটি ছিল জীববিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে এক বিশাল অর্জন।
১৯৬৮ সনে মার্শাল নিরেনবার্গ, হরগোবিন্দ খোরানা এবং রবার্ট হোলিকে যৌথভাবে চিকিৎসা অথবা জীববিজ্ঞান ক্যাটাগরিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। রবার্ট হোলিও সেই সময় ডিএনএ থেকে প্রোটিন তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছিলেন। তবে তাঁর কাজটি ছিল মূলত টি আর এন এ নিয়ে।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে হরগোবিন্দ খোরানা ইস্ট থেকে কৃত্রিম জিন সংশ্লেষণ করতে সক্ষম হন। এটিও ছিল সেই সময়কার জন্য এক বিস্ময়কর আবিষ্কার। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো বর্তমান যুগে বহুল ব্যবহৃত পলিমারেজ চেইন রিয়াকশন বা পিসিআর (PCR) এর প্রাথমিক ইঙ্গিত হরগোবিন্দ খোরানার ৮০ দশকের একটি গবেষণার মধ্যে দেখা যায়। নিঃসন্দেহে তিনি গবেষক হিসেবে তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন।
আমাদের উপমহাদেশে অনেক প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁদের বিস্ময়কর অবদান রয়েছে। কিন্তু তাঁদের অনেকের কথা আমরা এখন ভুলে গেছি। আমাদের দেশে বিজ্ঞানের জনপ্রিয়তা বাড়াতে ও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার ঘটাতে তাঁদের অবদানের কথা জানা খুবই প্রয়োজন।
Comments