বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা সময়ের অনেক আগেই চিন্তা করে ফেলেছিলেন ভবিষ্যতের প্রযুক্তি। নিকোলা টেসলা ছিলেন তাঁদেরই একজন। কিন্তু তাঁর জীবনের গল্পটা শুধু আবিষ্কারের নয়, এক অসাধারণ প্রতিভারও, যিনি সারা জীবন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জন্য কাজ করেও জীবনের শেষ প্রান্তে এসে হয়ে পড়েছিলেন একপ্রকার নিঃসঙ্গ ও বিস্মৃত।
১৮৫৬ সালে ক্রোয়েশিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নেন টেসলা। ছোটবেলা থেকেই তাঁর ছিল বিস্ময়কর কল্পনাশক্তি আর বিজ্ঞান নিয়ে তীব্র আগ্রহ। পড়াশোনা করেন অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরিতে, আর তারপর চলে যান আমেরিকায়। সেই আমেরিকাতেই তিনি শুরু করেন তাঁর আসল কাজ, বৈদ্যুতিক শক্তি নিয়ে যুগান্তকারী সব আবিষ্কার।
তিনি যে যুগে কাজ করতেন, তখন পৃথিবীতে ইলেকট্রিসিটি ছিল এক ধরনের নতুন ধারণা। কিন্তু টেসলা বুঝতে পেরেছিলেন, এই শক্তিই একদিন পুরো দুনিয়াকে বদলে দেবে। টেসলার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো "অলটারনেটিং কারেন্ট" বা AC বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
সে সময় অনেকেই বিশ্বাস করতেন, বিদ্যুৎ শুধু এক দিকেই প্রবাহিত হতে পারে। যেমনটা করেছিলেন থমাস আলভা এডিসন তাঁর "ডাইরেক্ট কারেন্ট" বা DC সিস্টেম দিয়ে। কিন্তু টেসলা দেখালেন, বিদ্যুৎ যদি অদল-বদল করে প্রবাহিত হয়, তাহলে তা হবে অনেক বেশি কার্যকর, বেশি দূরত্বে পরিবহণযোগ্য এবং নিরাপদ।
তাঁর এই আবিষ্কারই আজ আমাদের ঘরের ফ্যান, ফ্রিজ, টিভি, এসি—সবকিছু চালায়। AC সিস্টেম ছাড়া আধুনিক শহর কল্পনা করা যায় না।
কিন্তু এখান থেকেই শুরু হয় এক অসাধারণ দ্বন্দ্ব—টেসলা বনাম এডিসন। থমাস এডিসন তখন যুক্তরাষ্ট্রে বৈদ্যুতিক শক্তির প্রধান ব্যক্তি। তিনি ছিলেন DC বিদ্যুতের প্রবক্তা। যখন টেসলা AC সিস্টেম নিয়ে হাজির হলেন, তখন এডিসনের ব্যবসায়িক স্বার্থে টান পড়ল। তিনি এই নতুন ব্যবস্থাকে ঠেকাতে উঠে পড়ে লাগলেন। শুরু হলো কুৎসা আর ভয় দেখানোর এক অসম প্রতিযোগিতা। এডিসন এমনকি পশুদের উপর AC বিদ্যুৎ প্রয়োগ করে দেখাতে চাইলেন এটি কতটা বিপজ্জনক! ইলেকট্রিক চেয়ার আবিষ্কারের পেছনেও ছিল এই অপপ্রচারণার হাত। কিন্তু সত্য চেপে রাখা যায় না। ধীরে ধীরে প্রমাণিত হলো, টেসলার পদ্ধতিই বেশি কার্যকর, আর পুরো দুনিয়া আজ সেই পথেই চলছে।
কিন্তু টেসলা শুধু এখানেই থেমে যাননি। তিনি চেয়েছিলেন তারহীন শক্তি প্রেরণের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে। নিউইয়র্কে তিনি তৈরি করেছিলেন "ওয়ার্ডেনক্লিফ টাওয়ার" নামে এক বিশাল রেডিও টাওয়ার, যার মাধ্যমে তিনি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বিদ্যুৎ ও তথ্য তারবিহীনভাবে পাঠাতে চেয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি প্রাথমিক সাফল্যও অর্জন করেছিলেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, টেসলার সেই তার বিহীন বিদ্যুৎ প্রকল্প অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায়। আর টেসলা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকেন ইতিহাসের আড়ালে।
নিকোলা টেসলা ছিলেন এক বিস্ময়কর প্রতিভা, যাঁর আবিষ্কারের পরিধি ছিল অবিশ্বাস্যভাবে বিস্তৃত। তিনি বিশ্বের ২৬টি দেশে প্রায় ৩০০টির মতো পেটেন্ট লাভ করেছিলেন, যার মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ছিল ১১২টি। এসব পেটেন্টের মধ্যে ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থা, এসি মোটর, রেডিও যোগাযোগ, তারহীন শক্তি প্রেরণ, রিমোট কন্ট্রোল, এক্স-রে প্রযুক্তি, নিয়ন আলো, টেসলা কয়েল, এমনকি প্লাজমা ল্যাম্পের মতো যুগান্তকারী আবিষ্কার। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর উদ্ভাবন এতটাই সময়ের আগে ছিল যে সেগুলোর ব্যবহার শুরু হয় অনেক বছর পর। এমনও অনেক আবিষ্কার ছিল যা তিনি পেটেন্টই করেননি, আবার কিছু পেটেন্ট অন্যের নামে নথিভুক্ত হয়েছিল, যদিও মেধা ছিল টেসলার। আজও তাঁর সেই কাজগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।
টেসলার জীবনের শেষ দিনগুলো ছিল নিঃসঙ্গ। একা এক হোটেল কক্ষে থাকতেন নিউইয়র্ক শহরে। নতুন নতুন আবিষ্কারের জন্য তাঁর জীবনটা দিয়ে দিলেও তিনি কোনো বড় ধনী বা নামজাদা ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারেননি। বরং বহুবার তাঁর আইডিয়া চুরি হয়েছে, আর তিনি পড়ে থেকেছেন অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তার ভেতরে। ১৯৪৩ সালে, দরিদ্র ও একাকী অবস্থায় নিউইয়র্কের এক হোটেল কক্ষে তাঁর মৃত্যু হয়। তখনও পৃথিবী পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি, কত বড় একজন বিজ্ঞানীকে হারাল তারা।
কিন্তু আজ, টেসলার নাম আবার উঠে এসেছে নতুন করে। তাঁর আবিষ্কার, তাঁর কল্পনাশক্তি, আর ভবিষ্যতের জন্য তাঁর চিন্তা আজও বিজ্ঞানীদের অনুপ্রেরণা দেয়।
বর্তমান যুগের আধুনিক বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি “Tesla” তাঁর নামেই নামকরণ করা হয়েছে, যেন এই বিস্মৃত প্রতিভাকে সম্মান জানানো যায়। নিকোলা টেসলা ছিলেন বিজ্ঞান জগতের এক নিঃসঙ্গ প্রতিভা, যাঁর প্রস্তাবিত বিদ্যুত পরিবহন ব্যবস্থা এখনও ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর প্রতিটি কোনায় ।
Comments