বিজ্ঞানের ইতিহাসে ১৯০৫ সাল ছিল একটি যুগান্তকারী বছর। বিজ্ঞানীরা এই বছরকে বলেন Annus Mirabilis—অর্থাৎ অলৌকিক বছর। তার কারণ হলো, সে বছর আলবার্ট আইনস্টাইন নামের মাত্র ছাব্বিশ বছরের এক অখ্যাত জার্মান তরুণ পর পর চারটি বৈপ্লবিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন।এসব গবেষণা শুধু পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দেয়নি, বরং বিজ্ঞানের চিরায়ত দৃষ্টিভঙ্গিকেও পাল্টে দিয়েছিল।
আশ্চর্য ব্যাপার হলো, তখন আইনস্টাইন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন না। তিনি নামজাদা কোনো বিজ্ঞানীও ছিলেন না। তিনি পরীক্ষক হিসেবে কাজ করতেন সুইজারল্যান্ডের সরকারি পেটেন্ট অফিসে, যেখানে তাঁর কাজ ছিল নতুন আবিষ্কারের নথিপত্র যাচাই করে সেগুলোকে অনুমোদন দেওয়া। কিন্তু দিনের শেষে, ঘরে ফিরে গিয়ে নিজের মতো করে তিনি পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে যাচ্ছিলেন। তাঁর কোনো গবেষণা ল্যাব ছিল না, তিনি কোনো গবেষক দলে কাজ করতেন না। শুধু গভীর কৌতূহল আর অসাধারণ বিশ্লেষণ ক্ষমতা ছিল তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণার সম্বল।
প্রথম গবেষণাপত্রে তিনি আলো সম্পর্কে এক নতুন ব্যাখ্যা দিলেন। বললেন, আলো শুধু তরঙ্গ নয়, এর ভেতর ছোট ছোট শক্তির কণাও থাকে, যাদের তিনি বললেন “আলোক কোয়ান্টা”। (পরবর্তীতে এগুলোই ‘ফোটন’ নামে পরিচিত হয়।) এর মাধ্যমেই তিনি বোঝালেন কীভাবে আলো ধাতব পৃষ্ঠে পড়ে ইলেকট্রন ছুঁড়ে দিতে পারে। এটাকে বলা হয় ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট। এই কাজের স্বীকৃতিতেই পরে, ১৯২১ সালে, তিনি পান পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার। অনেকে ভাবেন তাঁর বিখ্যাত আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু না, আসলে সেটা ছিল আলোক কণাতত্ত্ব বা ফটোইলেকট্রিক প্রভাবের ব্যাখ্যার জন্য।
দ্বিতীয় গবেষণায় তিনি ব্যাখ্যা করেন ব্রাউনিয়ান গতি। পানির মধ্যে ভেসে থাকা অতি ক্ষুদ্র কণাগুলোর এলোমেলো নড়াচড়া দেখে অনেকেই অবাক হতেন। আইনস্টাইন দেখালেন, এই গতির পেছনে আছে অদৃশ্য পরমাণুদের অবিরাম ছোটাছুটি। পরমাণু যদি বাস্তবে থাকে, তাহলে তারাই ওই কণাগুলোকে ধাক্কা দিয়ে নাড়াচাড়া করাবে—এই ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি পরমাণুর বাস্তব অস্তিত্বের একটি শক্তিশালী প্রমাণ হাজির করলেন।
তৃতীয় গবেষণায় তিনি তুলে ধরেন বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। তিনি বললেন, সময় আর স্থান, এগুলো মোটেই ধ্রুব নয়, বরং আপেক্ষিক। একেকজন পর্যবেক্ষকের জন্য সময় আর দূরত্ব একেক রকম হতে পারে। আর আলোর গতি হচ্ছে একমাত্র গতি যা সব সময় অপরিবর্তিত থাকে। এটা ছিল তৎকালীন পদার্থবিজ্ঞানের জন্য এক চরম বিস্ময়।
চতুর্থ গবেষণায় আমাদের উপহার দেন পৃথিবী কাঁপানো এক সমীকরণ: E = mc²। এই ছোট্ট ফর্মুলার মানে হলো, ভর আর শক্তি একে অপরের রূপান্তর। একটুখানি ভরের ভেতরেও বিপুল পরিমাণ শক্তি লুকিয়ে থাকতে পারে। এটাকে বিশেষ আপেক্ষিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হিসেবেই ধরা হয়। এই তত্ত্বই পরবর্তীতে পারমাণবিক শক্তি আর পারমাণবিক বোমা তৈরির ভিত্তি হয়ে ওঠে।
এই চারটি গবেষণাপত্র ১৯০৫ সালে যখন প্রকাশিত হয়, তখনও বিজ্ঞানের দুনিয়া নিউটনের ক্লাসিকাল নিয়ম-কানুনে গভীরভাবে আস্থা রেখেছিল। কিন্তু আইনস্টাইনের নতুন চিন্তাধারা যেন সেই সনাতন কাঠামোতে এক প্রবল ঝাঁকুনি দিল। তিনি দেখালেন, মহাবিশ্বকে বুঝতে গেলে পুরনো ধ্যানধারণা নিয়ে বসে থাকলে আর চলবে না।
১৯০৫ সাল তাই শুধু বিজ্ঞান নয়, পুরো মানব ইতিহাসের জন্য এক অলৌকিক বছর হয়ে রইল। একজন তরুণ গবেষকের নিঃসঙ্গ চিন্তা গোটা বিশ্বের বিজ্ঞান চিন্তার রাস্তাকে বদলে দিল। আজও এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, গভীর কৌতূহল আর অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে একা একজন মানুষের পক্ষেও গোটা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়া সম্ভব।
Comments