মহাবিশ্বের সূচনা থেকেই শক্তির এক বিশাল উৎস হয়ে রয়েছে নিউক্লিয়ার ফিউশন। যে সূর্যকে আমরা প্রতিদিন আকাশে দেখি, তার আলো আর উত্তাপের মূলে রয়েছে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া। সূর্যের অভ্যন্তরে প্রচণ্ড তাপমাত্রা আর চাপের মধ্যে হাইড্রোজেন পরমাণু প্রতিনিয়ত হিলিয়াম পরমাণুতে পরিণত হচ্ছে আর এই রূপান্তরের ফাঁকে যে সামান্য ভরের ঘাটতি ঘটছে, সেটাই পরিণত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ শক্তিতে। আইনস্টাইনের বিখ্যাত ভর-শক্তির সূত্র, E=mc², এখানে তার বাস্তবতা খুঁজে পায়।
মানুষ বহু বছর ধরেই চেষ্টা করছে সূর্যের এই শক্তিকে পৃথিবীতে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু সেটা এত সহজ নয়। কারণ পৃথিবীতে সূর্যের মতো সেই ভয়ানক তাপমাত্রা বা চাপ স্বাভাবিকভাবে সৃষ্টি হয় না। তাই বিজ্ঞানীরা কৃত্রিমভাবে এই চরম পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছেন। আর সেই প্রচেষ্টার ফসল হলো ফিউশন রিঅ্যাক্টর। এই রিঅ্যাক্টর এমন একটি যন্ত্র, যেটা সূর্যের অভ্যন্তরের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। যেখানে হাইড্রোজেন বা তার ভারী রূপ, যেমন ডিউটেরিয়াম ও ট্রাইটিয়াম, একে অপরের সঙ্গে মিশে একটি নতুন পরমাণু তৈরি করে এবং সেইসঙ্গে প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয়।
একটি কার্যকর ফিউশন রিঅ্যাক্টর চালাতে হলে দুইটি মূল শর্ত পূরণ করতে হয়। প্রথমতঃ চরম তাপমাত্রায় প্লাজমা অবস্থা তৈরি করা এবং দ্বিতীয়তঃ যথেষ্ট সময় ধরে সেই প্লাজমা অবস্থাকে ধরে রাখা। বর্তমানের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রচলিত নিউক্লিয়ার ফিশনের চেয়ে এটি অনেক বেশি জটিল প্রক্রিয়া, কারণ এই প্লাজমা অবস্থা খুবই অস্থির এবং ক্ষণস্থায়ী।
প্লাজমাকে ধরে রাখার জন্য বিজ্ঞানীরা ম্যাগনেটিক কনফাইনমেন্ট (যেমন টোকামাক রিঅ্যাক্টর) বা ইনারশিয়াল কনফাইনমেন্ট (লেজার দিয়ে সংকোচন) পদ্ধতি ব্যবহার করেন। টোকামাক এক ধরনের ডোনাট আকৃতির চেম্বার যেখানে সুপারকন্ডাকটিং চুম্বকের মাধ্যমে প্লাজমাকে ভাসমান রাখা হয়। অন্যদিকে, ইনারশিয়াল কনফাইনমেন্ট পদ্ধতিতে ছোট একটি হাইড্রোজেন ভরাট গোলককে চারদিক থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী লেজার রশ্মি দিয়ে একযোগে আঘাত করা হয়। এই তীব্র লেজার চাপের ফলে ভেতরের পদার্থ আচমকা সংকুচিত হয়ে বিশাল তাপমাত্রা ও চাপ সৃষ্টি করে, যেটা ফিউশন বিক্রিয়ার জন্য যথেষ্ট।
ফিউশন শক্তির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটি পরিবেশবান্ধব এবং তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। বহুল ব্যবহৃত পারমাণবিক ফিশন রিঅ্যাক্টরের মতো এতে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য থাকে না। তাছাড়া, ফিউশন রিঅ্যাক্টরে ব্যবহৃত জ্বালানি পৃথিবীতে সহজলভ্য। ডিউটেরিয়াম সহজে সমুদ্রের পানিতে পাওয়া যায়, আর ট্রাইটিয়াম তৈরি করা যায় লিথিয়াম থেকে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এতে পারমাণবিক দুর্ঘটনার ঝুঁকি খুবই কম, কারণ যদি কিছু ভুল হয়, তাহলে ফিউশন রিঅ্যাকশন আপনাতেই বন্ধ হয়ে যায়। সেজন্য ফিউশন রিঅ্যাক্টর একটি নিরাপদ প্রযুক্তি। তবে এই অসাধারণ প্রযুক্তির পথে এখনো বহু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ফিউশন রিঅ্যাক্টর চালাতে যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন, অনেক সময় দেখা যায়, সেটির চেয়েও কম শক্তি উৎপন্ন হয়। বিজ্ঞানীরা যেটা চান, সেটা হলো যত শক্তি রিঅ্যাক্টরে ঢুকানো হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তি ফিরে পাওয়া।
বর্তমানে ফিউশন গবেষণায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে গণচীন। সম্প্রতি চীনে ইস্ট (EAST - Experimental Advanced Superconducting Tokamak) নামের একটি পরীক্ষামূলক ফিউশন রিঅ্যাক্টরে প্রায় ১০০০ সেকেন্ড বা ১৭ মিনিট ধরে সফলভাবে ফিউশন বিক্রিয়া ঘটানো হয়েছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে স্থিতিশীল প্লাজমা তৈরি করা এখন পর্যন্ত ফিউশন গবেষণার ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। ফিউশন বিক্রিয়া এত বেশি তাপমাত্রায় ঘটে যে, একে স্থিতিশীল করে ধরে রাখা খুবই কঠিন। আর এখানেই রয়েছে EAST রিঅ্যাক্টরের অসাধারণ সাফল্য। এটি প্রায় ১০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পৌঁছে গিয়েছিল, যেটা ছিল সূর্যের কেন্দ্রের চেয়েও প্রায় ছয় গুণ বেশি উত্তপ্ত!
এছাড়াও সাম্প্রতিক কিছু পরীক্ষায়, যেমন ইউরোপের JET রিঅ্যাক্টর বা আমেরিকার NIF ল্যাবরেটরি ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে। ইউরোপের দক্ষিণ ফ্রান্সে নির্মিত হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফিউশন প্রকল্প—ITER। এটা যদি সফল হয়, তাহলে এক নতুন যুগের সূচনা হবে।
আমেরিকা, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য সহ বহু দেশ নিজ নিজ উদ্যোগে ফিউশন গবেষণায় বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে। শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি খাতেও স্পার্ক, হেলিয়োন, কমনওয়েলথ ফিউশন ইত্যাদি কোম্পানি ভবিষ্যতের শক্তির এই উৎস নিয়ে কাজ করছে। বর্তমানে পৃথিবীর অন্তত ৫০টিরও বেশি দেশে ১৩০টির মতো ফিউশন রিঅ্যাক্টর নির্মাণাধীন কিংবা পরিকল্পনার বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। এই গবেষণাগুলির পেছনে লক্ষ্য একটাই—ভবিষ্যতের জন্য এক অবিশ্বাস্যরকম বিশুদ্ধ, নিরাপদ এবং প্রায় সীমাহীন শক্তির উৎস তৈরি করা।
ফিউশন রিঅ্যাক্টরের সম্ভাবনা শুধুই বিশাল নয়, এক কথায় বৈপ্লবিক। যদি বিজ্ঞানীরা সত্যিই এই প্রযুক্তিকে বাণিজ্যিকভাবে কার্যকর করতে পারেন, তাহলে বিশ্ব শক্তির মানচিত্রই বদলে যাবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমবে, কার্বন নিঃসরণ বন্ধ হবে, আর সমগ্র পৃথিবীর শক্তির চাহিদা মিটবে। এই স্বপ্ন এখন বাস্তবের পথে হাঁটছে, বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০৫০ সালের মধ্যেই আমরা প্রথম বাণিজ্যিক ফিউশন প্ল্যান্ট দেখতে পাবো। আর যদি সেটা সম্ভব হয়, তাহলে মানবসভ্যতা প্রথমবারের মতো এমন একটি শক্তির উৎস পাবে যেটা সীমাহীন, পরিচ্ছন্ন এবং নিরাপদ।
আশার কথা হলো, এই একটিমাত্র প্রযুক্তিই বদলে দিতে পারে পুরো মানব সভ্যতার গতিপথ। একসময় যেটা সম্ভব হয়েছিলো বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট বা মহাকাশযাত্রার মাধ্যমে। তাই বলা যায়, ফিউশন রিঅ্যাক্টর শুধুই এক বৈজ্ঞানিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়। এটি হচ্ছে, মানব সভ্যতার জন্য এক রক্ষাকবচ।
জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলায় এক বিশাল হাতিয়ার। সেই দিন হয়তো দূরে নয়, যখন পৃথিবীর মানুষ নিজেরাই তৈরি করবে পরিবেশ বান্ধব অমিত শক্তির উৎস, যেটা হবে সূর্যের মতোই সীমাহীন আর অফুরন্ত। আর সেই প্রমিথিউসের অপেক্ষাতেই সারা বিশ্ব এখন তাকিয়ে রয়েছে নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রযুক্তির দিকে।
Comments