মহাকাশের জলাধার


পৃথিবী থেকে প্রায় ১২ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে, মহাকাশ বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন এক অদ্ভুত এবং অবিশ্বাস্য জিনিস - বিশাল এক জলীয় মেঘ। অবাক করা বিষয় হলো, এই মেঘে যে পরিমাণ জলীয় বাষ্প রয়েছে, সেটা পৃথিবীর সব মহাসাগর মিলিয়ে যতটা পানি আছে, তার চেয়ে ১৪০ ট্রিলিয়ন গুণ বেশি! এমনই বিশাল এক মহাজাগতিক জলাধারের হদিস পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

এই বিশাল জলীয় রাজ্যটি ঘিরে রেখেছে একটি কোয়াসারকে, যার নাম APM 08279+5255। কোয়াসার হলো এমন এক মহাজাগতিক বস্তু, যার কেন্দ্রে রয়েছে একটি বিশালাকৃতির ব্ল্যাকহোল, আর সেটি আশেপাশের গ্যাস ও ধূলিকণাকে গিলে ফেলে এক ধরণের তীব্র আলো ও শক্তির বিস্ফোরণ ঘটায়। এই কোয়াসারটি এতটাই শক্তিশালী যে এটা এক হাজার ট্রিলিয়ন সূর্যের সমান শক্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে, আর এর কেন্দ্রীয় ব্ল্যাকহোলের ভর আমাদের সূর্যের চেয়ে ২০ বিলিয়ন গুণ বেশি!
জলীয় বাষ্পের এই গহ্বরের তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস ৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও, এটি আশেপাশের গ্যালাকটিক অঞ্চলের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি উষ্ণ। এর কারণ হলো, কোয়াসার থেকে নির্গত রশ্মি আশেপাশের গ্যাসকে এতটাই উত্তপ্ত করে তুলছে যে সেখানে বাষ্পের ঘনত্ব অন্য যেকোনো জায়গার তুলনায় প্রায় ১০০ গুণ বেশি। কয়েকশো আলোকবর্ষ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই জলীয় মেঘ কেবল তার বিশালতা দিয়েই নয়, তার গুরুত্ব দিয়েও বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করেছে।

সাধারণভাবে আমরা জানি, পানি যদি গ্যাসে পরিণত হয়, তবে তার আশেপাশে অবশ্যই অনেক উত্তাপ থাকতে হবে। কিন্তু মহাকাশে −৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও কীভাবে পানি গ্যাস হিসেবে থাকতে পারে, সেটাই বিস্ময়ের বিষয়। এর কারণ হলো, মহাকাশে চাপ বা প্রেশার প্রায় নেই বললেই চলে, একেবারে শূন্যের কাছাকাছি। পৃথিবীতে আমরা যে তাপমাত্রায় পানি ফুটতে দেখি, সেটা ঘটে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের চাপের জন্য। কিন্তু যদি চাপ একেবারে কমে যায়, তখন পানির আচরণ বদলে যায়। এমনকি বরফও গলে না, সরাসরি গ্যাসে রূপ নিতে পারে, যাকে বলে সাবলিমেশন।

এই কোয়াসারের চারপাশে ঠিক এমন পরিবেশ রয়েছে, যেটা প্রচণ্ড ঠান্ডা, কিন্তু সেখানকার চাপ শূন্যের কাছাকাছি।  ফলে পানি বরফ না হয়ে গ্যাস হিসেবেই ছড়িয়ে আছে মহাশূন্যে, যদিও সেটা আমাদের পরিচিত গরম বাষ্পের মতো নয়। এটা আসলে পানির অণুর এক বিশাল মেঘ, ঠান্ডা অবস্থায় মহাকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, মহাকাশের শূন্য চাপের কারণে −৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও পানি গ্যাস হিসেবে টিকে থাকতে পারে। পৃথিবীর তুলনায় এটি একেবারেই ভিন্ন বাস্তবতা।

সুদূর মহাকাশে এই বিশাল জলভাণ্ডার আবিষ্কার করে বিজ্ঞানীরা বিস্মিত। এই আবিষ্কারের মাধ্যমে মহাবিশ্বে কবে, কোথায় এবং কীভাবে পানি সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের সনাতনী ধারণা পাল্টে গেছে। এতটা দূরের কোনো স্থানে, যেখানে আলো পৌঁছাতেই লাগে ১২ বিলিয়ন বছর, সেখানে যদি এত বিশাল পরিমাণ জলীয় বাষ্পের অস্তিত্ব থাকে, তাহলে কি আমরা ধরে নিতে পারি, জীবন তৈরির মৌলিক উপাদানগুলো মহাবিশ্বের আদিমকাল থেকেই ছিল?

বিজ্ঞানীদের মতে, জলীয় বাষ্প কোন গ্রহে প্রাণের উদ্ভবের জন্য অত্যন্ত জরুরি উপাদান। তাই এই আবিষ্কার শুধু মহাকাশের রহস্য উন্মোচনই নয়, বরং ভবিষ্যতে কোথায় প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে, সেই প্রশ্নেরও নতুন সম্ভাবনা দেখিয়ে দেয়। মহাবিশ্ব যতই রহস্যময় হোক, তার ভেতরে ছড়িয়ে আছে জীবনের জলীয় উপাদান। আমাদের ছোট্ট এই পৃথিবীর সীমা ছাড়িয়ে, আরও অনেক দূরে, হয়তো ছড়িয়ে রয়েছে প্রাণের অপার সম্ভাবনা। 

তথ্যসূত্র: আর্থ ডটকম

Comments