সময়ের তিন মাত্রা?

আমরা সবাই জানি, সময়ের স্রোত একমুখী। অতীত থেকে চলে‌ এসেছে বর্তমানে, আর তারপর সময় এগিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে। কিন্তু যদি বলা হয়, এই ধারণা ভুল? যদি শোনা যায়, সময় আসলে একমাত্রিক নয়, বরং এরও রয়েছে তিনটি আলাদা মাত্রা? আর এই সময় থেকেই জন্ম নিয়েছে আমাদের অতি পরিচিত স্থান বা স্পেস?

এই অভাবনীয় কথাগুলো এখন আর কেবল কল্পবিজ্ঞান নয়। ফিনল্যান্ডের ট্যাম্পেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল পদার্থবিজ্ঞানী এমনই এক নতুন তত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছেন। এই তত্ত্ব আমাদের মহাবিশ্বের গঠনের ধরনটাই বদলে দিতে পারে। তাঁদের মতে, আমরা এতদিন যাকে  'স্পেস' বলে চিনেছি, সেটা আসলে সময়েরই এক ধরনের ছায়া। সময়ই আসলে মহাবিশ্বের মূল উপাদান, আর স্থান এসেছে পরে। অর্থাৎ, সময়ের ভেতর থেকেই জন্ম নিয়েছে স্পেস।

এই ভাবনার পেছনে রয়েছে একটি বিস্তৃত এবং জটিল গাণিতিক কাঠামো। গবেষকরা বলছেন, মহাবিশ্বের আদিতে ছিল এক বিশাল "টাইম-স্পেস" নয়, বরং ছিল কেবলমাত্র তিন-মাত্রিক সময়। সেখানে কোন ধরণের স্থানের অস্তিত্ব ছিল না। পরবর্তীতে সেই সময়ের গহ্বরে জন্ম নিয়েছে স্থান। যেটাকে তাঁরা বলছেন, “emergent space”, অর্থাৎ উদ্ভূত স্থান। যেমন, সমুদ্রের গভীর ঢেউ থেকে একসময় জন্ম নিতে পারে ফেনা, ঠিক তেমনি সময়ের গভীর গঠন থেকে গড়ে উঠেছে মহাবিশ্বের স্থানিক কাঠামো।

এই নতুন তত্ত্ব আমাদের অনেক পুরনো ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বে বলা হয়েছে, স্থান ও সময় একসাথে গড়ে তোলে একটি চার-মাত্রিক কাঠামো, যার নাম—স্পেসটাইম। কিন্তু এই নতুন তত্ত্ব বলছে, স্থান আসলে সময়ের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। আর তাই সময়ই এখানে মূল চালিকাশক্তি।
এই ধারণা যদি সত্যি হয়, তাহলে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের অনেক প্রশ্নের নতুন উত্তর পাওয়া যেতে পারে। যেমন, বিগ ব্যাং কি আসলেই মহাবিশ্বের শুরু? নাকি এরও আগে ছিল এক বিশাল সময়সমুদ্র, যার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে স্থান সৃষ্টি হয়েছে? এমনকি, ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্রে সময়ের এই গভীর গঠন কীভাবে স্থানকে দুমড়ে ফেলে তারও ব্যাখ্যা মিলতে পারে এই নতুন তত্ত্বে।

তবে এখনই এই তত্ত্বকে চূড়ান্ত বলে ধরা যাচ্ছে না। এর পক্ষে পর্যবেক্ষণগত প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। কিন্তু তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার দুনিয়ায় এটি এক নতুন জানালার মতো—যেখান দিয়ে আমরা হয়তো ভবিষ্যতের আরও বড়  কোন তত্ত্বের দিকে উঁকি দিতে পারি।

এই নতুন তত্ত্ব আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, মহাবিশ্বকে নিয়ে আমাদের এখনো কত অজানা, কত অপূর্ণ বোঝাপড়া রয়েছে। আমরা আজও সময়কে কেবল অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের ধারায় দেখেই সন্তুষ্ট, কিন্তু বাস্তবতা হতে পারে তার চেয়েও অনেক বেশি জটিল, অনেক বেশি গভীর। যদি সময় সত্যিই তিনটি মাত্রায় বিস্তৃত হয়, আর স্থান সেই সময় থেকেই গঠিত হয়ে থাকে, তাহলে মহাবিশ্বের মানচিত্র একেবারেই নতুনভাবে আঁকতে হবে।

তথ্যসূত্র: আর্থ ডট কম।

Comments