চাঁদের আকাশে পৃথিবী দেখা


মনে করুন, চাঁদের বুকে একা দাঁড়িয়ে আছেন আপনি। চারদিকে ধূসর পাথর, উঁচু-নিচু খানাখন্দ, আর প্রাচীন উল্কাপাতের ক্ষতচিহ্নে ভরা এক নীরব, অনাত্মীয় ভূখণ্ড। আপনার মাথার ওপর নিকষ কালো আকাশ। এখানে পৃথিবীর মত করে দিন-রাত্রি নেই। চাঁদের একদিন মানে পৃথিবীর দুই সপ্তাহ। তাই আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখানে হয়তো দু'সপ্তাহ ধরে চলছে একটানা রাত, অথবা একটানা দিন। 

চাঁদের আকাশে তারা আছে,  
কিন্তু সেই তারা গুলো মিটমিট করে জ্বলে না। চাঁদের কোনো বায়ুমণ্ডল নেই, তাই চাঁদের আকাশে তারার কোনো ঝিলিমিলি নেই। দিনের বেলা সূর্য আছে ঠিকই, কিন্তু পৃথিবীর মতো সূর্যের সোনালি আলো নয়। এক ধরনের ছায়াহীন সাদা আলোয় ঝলমল করছে সবকিছু। এই আলো এতটাই নিঃসঙ্গ যে, তাতে কোন উষ্ণতা নেই, শুধু একটা নিঃসাড় স্পষ্টতা।

এরই মধ্যে দাঁড়িয়ে, আপনি চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকালেন। আর সেখানেই দেখলেন এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। বিশাল এক নীল-সবুজ গোলক, যেন আকাশের গায়ে আটকে আছে। এটা আর অন্য কিছু নয়, এটাই আমাদের বাসভূমি পৃথিবী।

চাঁদের এমন কিছু জায়গা আছে, যেখান থেকে পৃথিবীকে সবসময়ই দেখা যায়, আকাশের একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে। চাঁদ থেকে পৃথিবীকে দেখলে মনে হবে আকাশের গায়ে ঝুলে আছে। কিন্তু পৃথিবী থেকে চাঁদকে যতটা বড় মনে হয়, পৃথিবীকে চাঁদ থেকে তার চেয়েও প্রায় ১৩ গুণ বড় মনে হবে। 

চাঁদের আকাশে পৃথিবী এক জায়গায় স্থির থাকে। যেন কেউ পৃথিবীকে স্থায়ীভাবে সেট করে রেখেছে চাঁদের আকাশে। এর কারণ হলো, চাঁদ পৃথিবীর সাথে "টাইডালি লকড" অবস্থায় থাকে। তার মানে, চাঁদ তার আবর্তনকাল ও পরিক্রমণকালকে এমনভাবে সাজিয়েছে যে, চাঁদের একটি পৃষ্ঠ পৃথিবীর দিকে সব সময়ই ফিরে থাকে। চাঁদের এই পিঠই আমরা পৃথিবী থেকে দেখতে পাই।  

সঙ্গত কারণেই, চাঁদের সেই পিঠ থেকে পৃথিবীকে সবসময়ই দেখা যায়, এবং আপাতদৃষ্টিতে প্রায় স্থির মনে হয়। তবে এটি পুরোপুরি স্থির নয়, ধীরে ধীরে এক পাশে দুলে ওঠে আবার অন্য পাশে ঝুঁকে পড়ে। এই হালকা দুলুনিকে বলে libration। তাই পৃথিবীকে চাঁদের আকাশে দেখে মনে হতে পারে, যেন একটু একটু দুলছে। 

চাঁদের আকাশে পৃথিবী তার‌ আপাত অবস্থান না বদলালেও, নিজের কক্ষের উপর ঘূর্ণনের কারণে পৃথিবীর চেহারা বদলে যায়। এত দূর থেকেও বোঝা যায়, পৃথিবীর মধ্যে জীবন আছে, গতি আছে। মহাসাগরগুলো ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে সূর্যের আলোতে, মেঘের দল এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশের দিকে ভেসে যাচ্ছে। পৃথিবীর এক পাশে যখন রাত, সেখানে ছোট ছোট আলোর রেখা, যেগুলো আসলে বড় বড় নগরীর রাতের আলো, অস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। অন্য পাশে ঝকঝকে দিনের আলোয় পাহাড়, মরুভূমি, নদী আর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জঙ্গল স্পষ্ট দেখা যায়। এইভাবে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার করে পৃথিবী তার আপন অক্ষে ঘুরে আসে। আপনি নিষ্প্রাণ চাঁদ থেকে পৃথিবীর প্রতিটি জীবন্ত পরিবর্তন চোখের সামনে দেখতে পাবেন।

চাঁদের বুকে দাঁড়িয়ে পৃথিবীকে দেখার অভিজ্ঞতা হলো আমাদের নিজের বাড়িকে বাইরে থেকে দর্শকের চোখে দেখার মতো। তখন আর পৃথিবী শুধু ‘আমাদের বাড়ি’ নয়, বরং একটি অনন্য, প্রাণময়, ঘূর্ণায়মান এবং আলোকোজ্জ্বল গ্রহ। সৌরজগতে পৃথিবীর মত এত সুন্দর আর কোন গ্রহ নেই। সেই নীল রঙ, সেই সাদা মেঘ, সবুজ বন, বাদামি পাহাড়—এটা শুধুমাত্র পৃথিবীরই অপরূপ রূপ। চাঁদ থেকে পৃথিবীকে দেখা মানে এক ধরনের পরাবাস্তব সৌন্দর্যকে দেখা। বিশাল মহাবিশ্বে আমরা কত ক্ষুদ্র, অথচ আমাদের গ্রহটি কতটা অনন্য। চাঁদ থেকে পৃথিবীকে দেখা মানে, নিজের অস্তিত্বকে নতুন চোখে দেখা। তখন আপনি শুধু একজন মানুষ নন, আপনি সেই গ্রহের প্রতিনিধি, যে গ্রহ সৌন্দর্য, জীবন আর সম্ভাবনার প্রতীক।

Comments