একটি নক্ষত্রের জীবন শুরু হয় মহাজাগতিক গ্যাস ও ধূলিকণার বিশাল মেঘ থেকে। যেখানে মূল উপাদান থাকে হাইড্রোজেন গ্যাস। এই গ্যাস যখন মহাকর্ষের প্রভাবে সংকুচিত হতে শুরু করে, তখন নক্ষত্রের কেন্দ্রে তাপমাত্রা ও চাপ বাড়ে। শুরু হয় নিউক্লিয়ার ফিউশন। এই ফিউশন প্রক্রিয়াতেই হাইড্রোজেন রূপান্তরিত হয় হিলিয়ামে এবং নক্ষত্রের কেন্দ্রে তৈরি হয় বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক শক্তি। এই শক্তি বাইরে ছড়িয়ে পড়ে এবং নক্ষত্রকে চাপে-তাপে ভারসাম্য বজায় রেখে প্রজ্বলিত থাকতে সাহায্য করে। এই অবস্থা কোটি কোটি বছর স্থায়ী হয়।
কিন্তু একসময় নক্ষত্রের হাইড্রোজেন জ্বালানি ফুরিয়ে আসে। তখন হিলিয়াম থেকে তৈরি হয় আরও ভারী মৌল, যেমন কার্বন, অক্সিজেন বা লোহা। এরপর ফিউশনের শক্তি ধীরে ধীরে কমে যায়। তখন নক্ষত্রের কেন্দ্রে যে মহাকর্ষ কাজ করছিল সেটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। ফলে নক্ষত্রের কোর হঠাৎ করে ধ্বসে পড়ে নিজের ভেতরে।
যদি নক্ষত্রটির ভর সূর্যের চেয়ে তুলনামূলক কম হয়, তাহলে কোরটি ধ্বসে পড়ে একটি সাদা বামন (white dwarf) নক্ষত্রে পরিণত হয়। সাদা বামন হচ্ছে একটি মৃত নক্ষত্র, যার কেন্দ্রীয় অঞ্চল অত্যন্ত ঘন এবং গরম। এরা আর কোনো নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া করে না। কিন্তু এদের ভেতরের ইলেকট্রন ডিজেনারেসি প্রেসার (electron degeneracy pressure) এর কারণে এরা ধ্বংস না হয়ে গিয়ে স্থির অবস্থায় থেকে যায়।
তবে এখানেই একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমা রয়েছে, যার নাম চন্দ্রশেখর সীমা। ১৯৩০ সালে তরুণ ভারতীয় বিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যম চন্দ্রশেখর দেখান, যদি কোনো সাদা বামনের ভর সূর্যের ভরের ১.৪ গুণের বেশি হয়, তাহলে ওই ইলেকট্রন প্রেসার আর তাকে ধরে রাখতে পারবে না। তখন কোরটি আরও চেপে যেতে থাকবে। সেই চাপে প্রচুর নিউট্রন কণা তৈরি হবে এবং অবশেষে কোরটি হয় নিউট্রন স্টার অথবা একটি ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে।
কিন্তু মূল নক্ষত্রটির ভর যদি অনেক বেশি হয়, সাধারণত সূর্যের ৮ থেকে ২০ গুণ বা তার চেয়েও বেশি, তাহলে তার মৃত্যু হয় একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে। এই বিস্ফোরণ নক্ষত্রটির বাইরের স্তরকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় মহাকাশে। কিন্তু কেন্দ্রীয় কোরটি থেকে যায় এবং যদি সেটি চন্দ্রশেখর সীমা অতিক্রম করে, তাহলে সেটি আর সাদা বামনে পরিণত না হয়ে সরাসরি ব্ল্যাকহোলে রূপান্তরিত হয়। এইভাবে তৈরি হওয়া ব্ল্যাকহোলকে বলা হয় "স্টেলার-ম্যাস ব্ল্যাকহোল"। এদের ভর সাধারণত সূর্যের ভরের কাছাকাছি থেকে শুরু করে দশ গুণের মত হতে পারে।
মহাবিশ্বে ব্ল্যাকহোল এক অত্যন্ত বিস্ময়কর বস্তু। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীকেও হার মানায় বাস্তবের ব্ল্যাকহোল। একে বুঝতে হলে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব সম্বন্ধে কিছুটা জানতে হবে।
আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব অনুসারে মহাবিশ্বে স্থান এবং কাল একই সূত্রে গাঁথা। আইনস্টাইন বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে স্থান এবং কালের যৌথ বুননেই মহাবিশ্বের অবকাঠামো গঠিত হয়েছে। একে বলা হয় স্পেস-টাইম, বাংলায় স্থান-কাল বলা যেতে পারে। বস্তুর উপস্থিতির জন্য স্থান-কালের চাদরে এক ধরনের কার্ভেচার বা বক্রতার সৃষ্টি হয়। স্থান-কালের এই বক্রতাটিকেই আমরা মহাকর্ষ বল হিসেবে দেখি।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, প্রবল মহাকর্ষ বলের প্রভাবে ব্ল্যাকহোলের ভেতর থেকে কোন কিছুই বের হতে পারে না, এমনকি কোন আলোর কণাও নয়। এর ফলে ব্ল্যাকহোল থাকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য। কিন্তু এর অভ্যন্তরে স্থান-কালের চাদরের বক্রতাটি অসীম আকার ধারণ করেছে। একে বলে, সিঙ্গুলারিটি। এখানে এসে স্থান এবং কাল একাকার হয়ে গেছে। সময় গেছে থেমে। পদার্থবিজ্ঞানের স্বাভাবিক নিয়মগুলি এখানে খাটে না। সেজন্য ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরে কি ঘটছে সেটা নিশ্চিত করা বলা কঠিন।
ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব বহু আগেই ধারণা করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে প্রথমবারের মতো একটি সম্ভাব্য ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল, যার নাম Cygnus X-1, এটি একটি এক্স-রে উৎস, যার আচরণ দেখে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন যে এখানে একটি অদৃশ্য অথচ ভীষণ ভরসম্পন্ন বস্তু আছে। তবে এই অনুমান অনেক বছর গবেষণার পরও নিশ্চিত প্রমাণে রূপ নিতে পারেনি। ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্বের সরাসরি নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় ২০১৫ সালে। সে বছর, দু'টো ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষের ফলে তৈরি হওয়া গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ সর্বপ্রথম ধরা পড়েছিল LIGO পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ইন্টারফেরোমিটারে।
স্টেলার-ম্যাস ব্ল্যাকহোল ছাড়াও আরও অনেক বিশাল ব্ল্যাকহোল রয়েছে, যাদের বলা হয় "সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল"। এদের গঠন একেবারেই আলাদা ধরনের। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, আদিম মহাবিশ্বের একেবারে শুরুর দিকে কিছু গ্যাসীয় মেঘ সরাসরি ধ্বসে পড়ে বিশাল ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়েছিল। আবার অন্য গবেষকদের মতে, ছোট ব্ল্যাকহোলগুলো একে একে মিলে মিশে বড় ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, বিগ ব্যাংয়ের পর পরই গঠিত হয়েছিল অসংখ্য প্রাইমোরডিয়াল ব্ল্যাকহোল, যেগুলো সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের উৎস হতে পারে।
কিছু কিছু সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের ভর লক্ষ কোটি সূর্যের সমান পর্যন্ত হতে দেখা গেছে। যেমন, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা স্যাজিটারিয়াস A*। এসব সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব শুধু তত্ত্ব বা পরোক্ষ প্রমাণে সীমাবদ্ধ নয়। এখন আমরা তার ছবি পর্যন্ত দেখতে পেরেছি। ২০১৯ সালে বিজ্ঞানীরা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি ব্ল্যাকহোলের সরাসরি চিত্র তুলতে সক্ষম হন। এটি ছিল M87 গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত একটি বিশাল ব্ল্যাকহোল, যার ভর প্রায় ৬৫০ কোটি সূর্যের সমান। এই ছবিটি তোলা হয়েছিল Event Horizon Telescope (EHT) নামের একটি বৈশ্বিক টেলিস্কোপ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রেডিও টেলিস্কোপগুলোকে একযোগে সংযুক্ত করে EHT একটি "পৃথিবী-আকারের টেলিস্কোপ" হিসেবে কাজ করে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্র নয়, বরং তার চারপাশে ঘূর্ণায়মান গ্যাস ও আলোককণার উজ্জ্বল রিং ধরা পড়ে। যার মাঝখানে থাকে একেবারে নিকষ অন্ধকার, যাকে বলা হয়, ইভেন্ট হরাইজন। এটাই হলো, ব্ল্যাকহোলের সীমানা। এর বাইরে কোন কিছু বের হতে পারে না। এরপর ২০২২ সালে, বিজ্ঞানীরা একই পদ্ধতিতে আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা স্যাজিটারিয়াস এ স্টার ব্ল্যাকহোলের ছবিও তুলতে সক্ষম হন। এই দুটি ছবিই ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে এক ঐতিহাসিক বাস্তবতায় পরিণত করেছে।
ব্ল্যাকহোলগুলো যখন জোড়ায় জোড়ায় ঘুরতে থাকে এবং একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায়, তখন তৈরি হয় মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। এই তরঙ্গ মহাকাশের স্থান-কালের গঠনে সামান্য কিন্তু পরিমাপযোগ্য পরিবর্তন ঘটায়। ২০১৫ সালের পর থেকে LIGO এবং পরবর্তীতে Virgo ও KAGRA, এইসব পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে অনেকগুলো ব্ল্যাকহোল সংঘর্ষ শনাক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্ল্যাকহোলের ভর, ঘূর্ণন এবং মার্জারের প্রকৃতি বোঝা সম্ভব হয়েছে। এখন আমরা জানি, প্রতিটি স্টেলার মাস ব্ল্যাকহোলের জন্মের পেছনে থাকে একেকটি তারার মৃত্যুর ইতিহাস। সাদা বামনের সীমা পেরিয়ে গেলে যেভাবে ব্ল্যাকহোল তৈরি হয়, সেটা শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞান নয়, পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নিয়মগুলোকেও বুঝতে সাহায্য করে।
পরিশেষে বলে রাখি, প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ব্ল্যাকহোল নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি তাত্ত্বিকভাবে দেখিয়েছিলেন, ব্ল্যাকহোলের ইভেন্ট হরাইজনের সীমানায় এক ধরনের বিকিরণ হয়। অত্যন্ত কম তাপমাত্রার এই বিকিরণকে বলা হয়, হকিং রেডিয়েশন। কোয়ান্টাম শূন্যতার মাঝে যেসব ভার্চুয়াল কণা এবং প্রতিকণার উদ্ভব হয় তারই কিছুটা হকিং রেডিয়েশন হিসেবে ইভেন্ট হরাইজনের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। এর ফলে ব্ল্যাকহোল ধীরে ধীরে তার ভর হারায়। এর আগে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল ব্ল্যাকহোলের চারপাশ থেকে কোন ধরনের বিকিরণই সম্ভব নয়। হকিংয়ের এই আবিষ্কারটি ব্ল্যাকহোল সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের পুরানো ধারনা একেবারেই পাল্টে যায়। হকিং রেডিয়েশনকে এখনো অবশ্য শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে ভবিষ্যতে যে সম্ভব হবে না, সেটা বলা হলফ করে বলা যায় না। আশা করা যায়, আগামী বছরগুলোতে বিজ্ঞানীদের কাছে ব্ল্যাকহোলের আরো অনেক রহস্যই উন্মোচিত হবে।
ছবি: স্যাজিটারিয়াস এ স্টার ব্ল্যাকহোল। ইউরোপিয়ান সাদার্ণ অবজারভেটরি।
Comments