১৯০৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন যখন বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রকাশ করেন, তখন তিনি ছিলেন মাত্র ছাব্বিশ বছরের এক অখ্যাত তরুণ। পেটেন্ট অফিসে চাকরি করতেন, নামডাকও তেমন ছিল না। কিন্তু তাঁর চিন্তার জোর ছিল অসাধারণ। বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব দিয়ে তিনি দেখান, স্থান ও কাল বা সময় আসলে আপেক্ষিক, এবং এরা একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আর আলোর গতি সব জায়গায় ধ্রুব। এই নতুন তত্ত্ব পুরো বিজ্ঞানের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। তবে এর মধ্যে একটা সীমাবদ্ধতা ছিল। কারণ এই তত্ত্ব কেবলমাত্র ‘জড় কাঠামো’তে প্রযোজ্য—অর্থাৎ যেখানে কোনো বাহ্যিক বল নেই, এবং বস্তু সমগতিতে বা ত্বরণহীন অবস্থায় থাকে।
কিন্তু বাস্তব জগতে কি সবকিছু স্থির? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল, মহাকর্ষ কিভাবে কাজ করে? আইনস্টাইন জানতেন, নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব বেশ কার্যকর হলেও, সেটি প্রকৃতির গভীর সত্যের সন্ধান দেয় না। নিউটনের মতে, এক বস্তু আরেকটি বস্তুকে দূর থেকে আকর্ষণ করে এক অদৃশ্য বলের মাধ্যমে। কিন্তু এই বল ঠিক কিভাবে ছড়ায়, কত সময়ে পৌঁছায়, তার কোনো ব্যাখ্যা নিউটনের তত্ত্বে নেই। আর বিশেষ আপেক্ষিকতার নিয়ম অনুযায়ী, কোনো কিছু আলোর গতির চেয়ে দ্রুত চলতে পারে না। তাহলে মহাকর্ষ কি সত্যিই তাৎক্ষণিকভাবে কাজ করে? এই দোটানাই আইনস্টাইনকে ঠেলে দিল এক নতুন চিন্তার পথে।
১৯০৭ সালে একদিন হঠাৎ করেই তাঁর মাথায় আসে এক আশ্চর্য চিন্তা। তিনি ভাবলেন, কেউ যদি একটি বদ্ধ ঘরে থাকে এবং সেই ঘরটি যদি নীচে পড়তে থাকে, অর্থাৎ ফ্রি-ফলে থাকে, তাহলে সে নিজের ওজন অনুভব করবে না। তার মনে হবে সে যেন শূন্যে ভাসছে। আবার, যদি সেই ঘরটি মহাশূন্যে উপর দিকে ত্বরণে ছুটে চলে, তাহলেও সে ঠিক একই রকম চাপ অনুভব করবে, যেন সে পৃথিবীর মহাকর্ষে দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ, মহাকর্ষ বল আর ত্বরণ—এই দুটোর মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। এটিই ছিল "সমতুল্যতার নীতি", যা সাধারণ আপেক্ষিকতার মূল ভিত্তি।
এই ধারণা মাথায় নিয়ে তিনি ধীরে ধীরে গড়ে তুললেন নতুন এক মহাকর্ষ তত্ত্ব। তিনি বুঝতে পারলেন, মহাকর্ষ আসলে কোনো বাহ্যিক বল নয়। বরং, ভরযুক্ত বস্তুগুলো স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়, আর অন্য বস্তুগুলো সেই বাঁকা পথ অনুসরণ করেই চলে। ঠিক যেমন, একটি ভারী বল যদি রাবারের চাদরের উপর রাখা হয়, তাহলে সেই চাদরের উপরে থাকা ছোট ছোট বলগুলো গড়াতে শুরু করবে ভারী বলটির চারদিকে। কারণ রাবারের চাদরটা ভারী বলটির দিকে বেঁকে গেছে। মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা ঠিক এমনই, শুধু পার্থক্য হলো, এখানে চাদর নয়, বস্তুর ভরের কারণে স্থান-কাল নিজেই বেঁকে যায়।
এই ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে শুরু হয় আইনস্টাইনের কঠিন গাণিতিক পথচলা। আইনস্টাইন সাহায্য নেন তাঁর সহপাঠী মার্সেল গ্রসম্যানের, যিনি ছিলেন একজন দক্ষ গাণিতিক।
রিম্যানের জ্যামিতি, টেনসর ক্যালকুলাস—এসব গাণিতিক কাঠামো ব্যবহার করে আইনস্টাইন তৈরি করলেন এমন এক অসাধারণ সমীকরণ, যেখানে বস্তুর ভর বলে দেয় স্থান-কালকে কিভাবে বাঁকতে হবে, আর সেই বাঁকা স্থান-কাল বলে দেয় বস্তুকে কিভাবে চলতে হবে।
১৯১৫ সালের নভেম্বরে, বার্লিনের প্রুশিয়ান অ্যাকাডেমিতে আইনস্টাইন তাঁর সেই বিখ্যাত গবেষণাপত্র পেশ করেন। এতে ছিল সেই চমকপ্রদ সমীকরণ—যা পরবর্তীতে “Einstein Field Equation” নামে পরিচিত হয়। এই সমীকরণে দেখানো হয়, মহাকর্ষ মানে হলো স্থান ও কালের বক্রতা। এটি মূলত একটি জ্যামিতিক ব্যাপার।
কিন্তু একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব তখনই শক্তিশালী প্রমাণিত হয়, যখন তা বাস্তবে পরীক্ষিত হয়। সাধারণ আপেক্ষিকতার ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা শুরু হতে লাগে কিছুটা সময়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে বিজ্ঞানী ও গবেষকরা তখন এ ব্যাপারে মনোনিবেশ করতে পারেননি। অবশেষে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, ১৯১৯ সালের মে মাসে, ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্যার আর্থার এডিংটন একটি পূর্ণ সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেলেন। তিনি পরীক্ষা করলেন, সূর্যের পাশ দিয়ে আসা দূরবর্তী নক্ষত্র থেকে আসা আলোর রশ্মি সূর্যের মহাকর্ষের কারণে একটু বাঁকছে কিনা। আর ঠিক সেটাই প্রমাণিত হলো, যেমনটা আইনস্টাইন চার বছর আগে তাঁর আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
এই ফলাফল পেয়ে গোটা দুনিয়া যেন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। পত্রিকাগুলো হেডলাইন করলো, "বিজ্ঞানের বিপ্লব: মহাবিশ্বের নতুন থিওরি"।
এইভাবেই বিশেষ আপেক্ষিকতা থেকে শুরু করে সাধারণ আপেক্ষিকতার অনন্য উচ্চতায় প্রবেশ করেছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। তিনি শুধু মহাকর্ষের যুগান্তকারী ব্যাখ্যাই দেননি, তিনি বদলে দিয়েছিলেন স্থান-কাল ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের সনাতনী ধারণা।
Comments