আদিম ব্ল্যাকহোল ও মহাবিশ্বের উৎপত্তি

বিজ্ঞানীদের ধারণা, আমাদের এই বিশাল মহাবিশ্বের শুরুটা হয়েছিল একটা মহা বিস্ফোরণ থেকে, যাকে বলা হয়, বিগ ব্যাং। এর আগে সময় ছিল না, স্থান ছিল না, পদার্থও ছিল না। সবকিছুই যেন হঠাৎ করে এক মুহূর্তে বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছিল। এটাই এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানের সবচেয়ে প্রচলিত ব্যাখ্যা। 

কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এই কাহিনিটা হয়তো পুরোপুরি ঠিক নয়। কারণ, বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের পুরোনো এক তত্ত্ব আবার ফিরে এসেছে আলোচনায়, আর সেটাই বদলে দিতে পারে মহাবিশ্বের জন্ম নিয়ে বিজ্ঞানীদের ভাবনার ভিত্তি।

১৯৭০ এর দশকে, হকিং বলেছিলেন, বিগ ব্যাংয়ের সময়ই সৃষ্টি হয়েছিল এক ধরনের অতি ক্ষুদ্র কিন্তু ভীষণ ঘন কিছু ব্ল্যাকহোল। যাদের নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘প্রাইমোরডিয়াল ব্ল্যাকহোল’‌ বা আদিম ব্ল্যাকহোল। এরা ছিল একেকটা ক্ষুদে শক্তির পিণ্ড। এই ব্ল্যাকহোলগুলো তখনকার মহাবিশ্বের জটিল অস্থিতিশীলতার মাঝে হঠাৎ করেই গঠিত হয়েছিল। তবে অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা, এরা খুব বেশিদিন টেকেনি। হকিং-এর প্রস্তাবিত একটি তত্ত্ব অনুসারে, এই ক্ষুদ্র ব্ল্যাকহোলগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে শুরু করে, এক ধরনের বিকিরণের মাধ্যমে, যাকে বলা হয়, "হকিং রেডিয়েশন"।

এই বিলীন হওয়ার পথে, এই ব্ল্যাকহোলগুলো ছড়িয়ে দেয় বিপুল পরিমাণ শক্তি। বিজ্ঞানীদের মতে, সেই শক্তির প্রভাবে মহাবিশ্বের প্রথম কাঠামো গঠিত হতে পারে। এই প্রক্রিয়ার ফলে তৈরি হওয়া ক্ষুদ্র কণা বা বিকিরণ আজও মহাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকতে পারে। তাদের বলা হচ্ছে ‘হকিং রেলিক্স’, তবে এই নাম এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এদের চোখে দেখা যায় না, ধরা-ছোঁয়াও যায় না, কিন্তু মহাবিশ্বের ভারসাম্য রক্ষা করতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এমনকি, বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই রহস্যময় কণাগুলিই হতে পারে সেই বহু প্রতীক্ষিত ডার্ক ম্যাটারের উৎস, যেটা গোটা মহাবিশ্বের ৮৫ ভাগ পদার্থ গঠন করে, অথচ সরাসরি দেখা যায় না।

ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, এই তত্ত্বকে বাস্তবের আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা। ২০২৫ সালের জুন মাসে প্রকাশিত এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, যদি এই আদিম ব্ল্যাকহোলগুলো এখনও থেকে থাকে এবং তারা যদি আমাদের সৌরজগতের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, তখন সেগুলো এক ধরনের নির্দিষ্ট বিকিরণ ছড়াবে। এই বিকিরণ মহাকাশে অবস্থানরত ডিটেক্টর, যেমন AMS-02 (আলফা ম্যাগনেটিক স্পেকট্রোমিটার), দিয়ে শনাক্ত করা সম্ভব হতে পারে। যদি সেই বিকিরণ আমরা ধরতে পারি, তাহলে প্রথমবারের মতো প্রাইমোরডিয়াল ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করা যাবে।

একই সময়ে আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, হকিং রেডিয়েশন আগে যেভাবে কল্পনা করা হতো, তার চেয়ে অনেক ধীর গতিতে ঘটে। এর মানে দাঁড়ায়, কিছু হালকা ভরের আদিম ব্ল্যাকহোল হয়তো আজও টিকে থাকতে পারে। এবং সেগুলো হতে পারে ডার্ক ম্যাটারের সবচেয়ে সম্ভাব্য উৎস। 

এই তত্ত্বকে আরও জোরালো করে তুলেছে সাম্প্রতিক জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণ। এই টেলিস্কোপ এমন কিছু গ্যালাক্সির সন্ধান দিয়েছে, যেগুলো বিগ ব্যাংয়ের খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিশাল ব্ল্যাকহোল তৈরি করে ফেলেছে। এটা এতটাই অস্বাভাবিক যে, অনেক বিজ্ঞানী মনে করছেন, এই সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলগুলোর জন্মের পেছনে ভূমিকা থাকতে পারে প্রাইমোরডিয়াল ব্ল্যাকহোলের।

সবচেয়ে রোমাঞ্চকর তথ্য এসেছে ভূমধ্যসাগরের গভীর থেকে। কেএম৩নেট (KM3NeT) নামের এক গভীর সামুদ্রিক ডিটেক্টর সম্প্রতি একটি অতি শক্তিশালী নিউট্রিনো কণা শনাক্ত করেছে, যেটা এক বিস্ফোরিত আদিম ব্ল্যাকহোল থেকে আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমন এক কণা, যার অস্তিত্ব হকিং অনেক আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। যদিও এটি এখনো নিশ্চিত নয়, তবু এই ধরণের কণার সন্ধান হকিং-এর তত্ত্বকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলছে।

এই সমস্ত তথ্য এখন বিজ্ঞানীদের নতুন করে ভাবাচ্ছে। এমনও হতে পারে, বিগ ব্যাং কোনো "বিস্ফোরণ" ছিল না। বরং সেটা ছিল এক ধরনের মহাজাগতিক রূপান্তর প্রক্রিয়া, যেটি আরেকটি মহাবিশ্বের কোনো ব্ল্যাকহোলের অন্তর্গত কোন ঘটনা ছিল।  আর যদি তা-ই হয়, তাহলে মহাবিশ্বের শুরুর গল্পটা আবার নতুন করে লেখা দরকার। হকিং হয়তো অনেক আগেই সেটা লিখে রেখে গেছেন, শুধু আমরা তখন বুঝে উঠতে পারিনি। এখন সেটা নতুন করে বোঝার সময় এসেছে।

Comments