আমাদের মহাবিশ্ব অনেক অজানা রহস্যে ভরা। ডার্ক ম্যাটার আসলে কী? বস্তুকণার ভর কোত্থেকে আসে? মহাবিশ্ব কেন এত নিখুঁতভাবে ভারসাম্যপূর্ণ? এইসব অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে আধুনিক পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে আকর্ষণীয় তত্ত্বগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, সুপারসিমেট্রি (SUSY) তত্ত্ব। এই তত্ত্ব যদি সত্যি হয়, তবে প্রকৃতির গভীরতম স্তর বোঝার ক্ষেত্রে এটি বিপ্লব ঘটাতে পারে।
সাধারণভাবে বলা যায়, সুপারসিমেট্রি হলো স্ট্যান্ডার্ড মডেলের একটি সম্প্রসারিত তত্ত্ব। স্ট্যান্ডার্ড মডেল হচ্ছে, একটি তাত্ত্বিক কাঠামো যা মহাবিশ্বের সব পরিচিত মৌলিক কণা এবং সকল প্রাকৃতিক বলের (মহাকর্ষ ছাড়া) ব্যাখ্যা দিতে পারে।
সুপারসিমেট্রি অনুসারে, প্রত্যেক মৌলিক কণার একটি “সুপারসঙ্গী” (Superpartner) বা অদেখা যমজ কণা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়:
• ইলেকট্রনের সুপারসঙ্গী হলো সিলেকট্রন।
• কোয়ার্কের সুপারসঙ্গী হলো স্কোয়ার্ক।
• ফোটনের সুপারসঙ্গী হলো ফোটিনো।
এই সুপারসঙ্গী কণাগুলোর চার্জ ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য পরিচিত কণার মতোই, তবে তাদের স্পিন (Spin) বা কোয়ান্টাম ধর্ম সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আগেই বলেছি, সুপারসিমেট্রি দিয়ে মহাবিশ্বের অনেক অজানা রহস্যের সমাধান করা সম্ভব। যেমন ধরুন:
১. ডার্ক ম্যাটারের রহস্য সমাধান: পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ডার্ক ম্যাটার, যা আমাদের চেনা মহাবিশ্বের প্রায় ৮৫% ভর গঠন করে। ডার্ক ম্যাটারকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, কিন্তু এর মহাকর্ষ কাজ করে দৃশ্যমান সকল বস্তুর উপর। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সুপারসিমেট্রিক কণাগুলোর মধ্যে একটিকে (যেমন: নিউট্রালিনো) ডার্ক ম্যাটারের সম্ভাব্য কণা হিসেবে ধরা যেতে পারে। যদি সুপারসিমেট্রি সত্য হয়, তবে এটি ব্যাখ্যা করতে পারবে কেন গ্যালাক্সিগুলো ছিন্নভিন্ন না হয়ে একসঙ্গে অবস্থান করছে।
২. মহাবিশ্বের মৌলিক বলগুলোর সংযুক্তি:
বিজ্ঞানীরা জানেন, মহাবিশ্ব চারটি মৌলিক বলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। এগুলো হলো: মহাকর্ষ বল, তড়িৎ চৌম্বকীয় বল, দুর্বল নিউক্লিয়ার বল এবং শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল। স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুসারে, এই বলগুলো বিভিন্ন শক্তি স্তরে আলাদাভাবে কাজ করে। কিন্তু সুপারসিমেট্রি অনুমান করে, উচ্চ শক্তির স্তরে এই চারটি বল একত্রিত হতে পারে। এটি পদার্থবিজ্ঞানের মূল ভিত্তি, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও মহাকর্ষের মধ্যে একটি সংযোগ তৈরি করতে পারে।
৩. হিগস বোসনের ভর ব্যাখ্যা করা: বিজ্ঞানীরা জানেন, হিগস বোসন মৌলিক কণাগুলোকে ভর প্রদান করে। কিন্তু স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুসারে হিগস বোসনের ভর অনেক বেশি হওয়া উচিত ছিল। সুপারসিমেট্রি এই সমস্যা সমাধান করতে পারে। সুপারসিমেট্রিক কণাগুলো কণা ও শক্তির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে, যার ফলে হিগস বোসনের ভর স্থিতিশীল থাকে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, সুপারসিমেট্রি কী আদৌ আবিষ্কৃত হয়েছে? সুন্দর তত্ত্ব হলেও, এখনও পর্যন্ত সুপারসিমেট্রিক কণার অস্তিত্বের সরাসরি কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীরা সুপারসিমেট্রিক কণাগুলো খুঁজতে CERN-এর লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে (LHC) বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সুপারসিমেট্রিক কণা ধরা পড়েনি। এর ফলে, কিছু কিছু বিজ্ঞানীদের মনে সংশয় তৈরি করেছে। কিন্তু, তত্ত্বটি এখনো বাতিল হয়ে যায়নি।
সুপারসিমেট্রিক কণা খুঁজে না পাওয়ার সম্ভাব্য ব্যাখ্যাগুলো হলো, সুপারসিমেট্রিক কণাগুলো প্রত্যাশার চেয়ে হালকা হতে পারে, যা শনাক্ত করার জন্য আরও শক্তিশালী পার্টিকেল এক্সেলেটর দরকার হবে। আবার এমনও হতে পারে, সুপারসিমেট্রি আংশিকভাবে সত্য অর্থাৎ শুধুমাত্র অল্প কিছু সুপারসিমেট্রিক কণা বিদ্যমান থাকতে পারে। কিন্তু যদি সুপারসিমেট্রি তত্ত্ব সত্য বলে প্রমাণিত হয়, তবে এটি হবে পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে বড় আবিষ্কারগুলোর একটি। এটি মহাবিশ্বের চূড়ান্ত তত্ত্ব, বা "থিওরি অফ এভরিথিং" এর দিকে বিজ্ঞানীদের এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে।
অন্যদিকে, যদি সুপারসিমেট্রি ভুল প্রমাণিত হয়, তাহলে মহাবিশ্বের মৌলিক প্রকৃতি ব্যাখ্যা করার জন্য বিজ্ঞানীদের নতুন কোন তত্ত্ব খুঁজতে হবে। বলাই বাহুল্য, মহাবিশ্বের রহস্যকে বোঝার জন্য মানুষের অবিরাম অভিযাত্রা চলতেই থাকবে।
Comments