আজ ৮ মে, ২০২৫। প্রকৃতিবিদ ডেভিড অ্যাটেনবোরোর ৯৯ তম জন্মদিন। ১৯২৬ সালের এই দিনে ইংল্যান্ডে জন্ম নেয়া ডেভিড অ্যাটেনবোরো তরুণ বয়স থেকেই জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করেছেন। সারাজীবন ধরে পৃথিবীর সব কটি মহাদেশে ঘুরে বেড়িয়ে তৈরি করেছেন অসংখ্য ডকুমেন্টারি।
BBC-র “Life on Earth” সিরিজ থেকে শুরু করে “The Blue Planet”, “Planet Earth” এবং “Our Planet”-এর মতো বহু ডকুমেন্টারিতে তাঁর কণ্ঠে যেন প্রকৃতি নিজের গল্প বলেছে। তাঁর ভয়েসওভার মানেই একটি সাবলীল, শান্ত অথচ এক গভীর বার্তা- প্রকৃতিকে ভালোবাসো, তার থেকে দূরে সরে যেও না। এমনকি বয়স যখন নব্বই ছুঁয়েছে, তখনও তাঁকে দেখা গেছে বরফ ঢাকা প্রান্তরে বা গহীন অরণ্যে হাঁটছেন, শুধুমাত্র এই পৃথিবীর গল্পটা আমাদের আরও একটু ভালো করে বলতে। এসব ডকুমেন্টারিতে তিনি পৃথিবীর নানা অঞ্চলের বিচিত্র সব প্রাণী এবং উদ্ভিদের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, আমাদের গ্রহটি জীববৈচিত্র্যে কতটা ভরপুর, কতটা সুন্দর এবং মনোহর।
কয়েক বছর আগে, তাঁর একটি ডকুমেন্টারি মুক্তি পেয়েছিল। এর নাম হলো, David Attenborough: A Life On Our Planet। প্রায় দুই ঘণ্টার এই ডকুমেন্টারিতে ডেভিড অ্যাটেনবোরোর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কাহিনী বলেছেন। এই ডকুমেন্টারিতে তিনি তুলে ধরেছেন, প্রকৃতির সাথে তাঁর নিজের দীর্ঘ জীবনের সম্পৃক্ততার কথা। কিন্তু সেই সাথে তিনি দেখিয়েছেন, মানুষ কীভাবে বছরের পর বছর ধরে জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে চলেছে, সেই করুণ ইতিহাস। এটি তিনি তাঁর নিজের জীবদ্দশায়ই প্রত্যক্ষ করেছেন। এর সাক্ষী তিনি নিজেই।
এই পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ প্রজাতির প্রাণী এবং উদ্ভিদ রয়েছে। এরা প্রকৃতির উপর নির্ভর করে বেঁচে রয়েছে। প্রকৃতির সাথে তাদের কোনো বিরোধ নেই। মানুষও প্রকৃতিরই সন্তান। কিন্তু মানুষ হলো প্রকৃতির অবাধ্য সন্তান। সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়ে মানুষ প্রকৃতিকে বশ করতে চায়। পৃথিবীতে মানুষের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এই বাড়তি জনসংখ্যার খাদ্য, কর্ম এবং বাসস্থানের সংস্থান করতে গিয়ে মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অন্যান্য প্রাণী এবং উদ্ভিদের উপর। মানুষ মনে করে এই পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ শুধু তার একার ভোগের জন্য। যুগ যুগ ধরে মানুষের অদূরদর্শিতা এবং অবিমৃষ্যকারীতার কারণে বনভূমি হয়েছে উজাড়, জলাভূমি হয়েছে বিষাক্ত, অনেক প্রজাতি হয়েছে বিলুপ্ত। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, মানুষের লাগামছাড়া উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে ধীরে ধীরে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড সহ অন্যান্য গ্রীনহাউজ গ্যাসের মাত্রা বাড়ছে। যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হলো জলবায়ু পরিবর্তন। কয়েক লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীর জলবায়ুতে যে স্থিতিশীলতা ছিল সেটা এখন হুমকির সম্মুখীন। মানুষই একমাত্র প্রজাতি যে তার কর্মকাণ্ড দিয়ে পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশকে এভাবে বদলে দিতে পারে। ডেভিড অ্যাটেনবোরো এটি প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁর নিজের দীর্ঘ জীবনে। এর ভয়াবহতার কথাই তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর এই ডকুমেন্টারিতে।
তাঁর জীবদ্দশায় তিনি দেখেছেন, পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের লীলাভূমি রেইন ফরেস্টের সার্বিক আয়তন প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। উত্তর মেরুর বরফ গলে গেছে প্রায় শতকরা চল্লিশ ভাগ। আর কয়েক দশক পর গ্রীষ্মকালে উত্তর মেরুতে আর বরফ দেখা যাবে না। সমুদ্রে নির্বিচারে মৎস্য শিকারের ফলে সামুদ্রিক মাছের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। উপকূলগুলোতে অনেক প্রজাতির মাছ এখন আর দেখা যায় না। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলবর্তী প্রবাল প্রাচীরগুলো ধ্বংসের সম্মুখীন। গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবে পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পাবে। পৃথিবীর অনেক অঞ্চল তখন বসবাসের জন্য সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে যাবে। বৃষ্টিপাতের অভাবে সুজলা সুফলা শস্যভূমি মরুভূমিতে পরিণত হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বহুমাত্রায় বেড়ে যাবে। বিপন্ন হবে পরিবেশ। পৃথিবীতে তখন মানুষের পক্ষে টিকে থাকাটাই অত্যন্ত কঠিন হয়ে যাবে। এক কথায় বলা যায়, ভয়াবহ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে মানুষের জন্য।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা কী এই ভয়ঙ্কর পৃথিবীই রেখে যাচ্ছি? নাকি এর থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় রয়েছে? ডেভিড অ্যাটেনবোরো বলেছেন, আমরা যতই দেরি করবো, সমস্যা ততই বাড়বে। এর সমাধান করাটাও ততোই কঠিন হয়ে পড়বে। সেজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমতঃ পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পৃথিবীর জনসংখ্যা এখন ৮ বিলিয়ন। বর্তমান হারে বাড়তে থাকলে এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে ১১ বিলিয়ন। বলাই বাহুল্য, তখন এই জনসংখ্যার চাপ সামলানো হবে অত্যন্ত কঠিন। সে জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। মানুষের ভেতর শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করে এটি করা সম্ভব।
দ্বিতীয়তঃ নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যাপক ব্যবহার করতে হবে। সৌর বিদ্যুৎ, উইন্ড টারবাইন, জলবিদ্যুৎ, জিও থার্মাল ইত্যাদি বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর আমাদের নির্ভরশীলতা একদম কমিয়ে ফেলতে হবে। এতে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ অনেক কমে যাবে। মোদ্দা কথা হলো, প্রকৃতির রুদ্ররোষ থেকে বাঁচতে হলে প্রকৃতির কাছেই ফিরে যেতে হবে। এটা করতে হবে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই।
তৃতীয়তঃ আমাদের খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। খাদ্যের জন্য প্রাণীর উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে অধিক মাত্রায় নিরামিষাশী হতে হবে। গবাদিপশুর সংখ্যা অনেক কমিয়ে আনতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে টেকসই কিন্তু উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি জমির পরিমাণও কমিয়ে আনতে হবে। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করে, অধিক মাত্রায় বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে হবে। প্রকৃতির কাছ থেকে যা কিছু নিয়েছি তা আবার ফিরিয়ে দিতে হবে প্রকৃতিকে।
ডেভিড অ্যাটেনবোরোর নিরাশ হন নি। তিনি জানেন এ ব্যাপারে জনসচেতনতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ সচেতন হলে অদূর ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন হবে। সম্প্রতি বিবিসি-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “আমার সময় শেষ হতে চলেছে, কিন্তু আমার স্বপ্ন এখনও বেঁচে আছে। আমি চাই এই পৃথিবীটা ভবিষ্যতের মানুষের জন্যও বাসযোগ্য থাকুক।”
এমন আশাবাদী কথা যখন তিনি বলেন, তখন মনে হয়, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের এই সুন্দর গ্রহটির প্রাকৃতিক পরিবেশ হয়তো শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাবে। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। শুভ জন্মদিন স্যার ডেভিড অ্যাটেনবোরো।
ছবি কৃতজ্ঞতা: রয়েল সোসাইটি।
Comments