প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী এরভিন শ্রোডিঙ্গার ১৮৮৭ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন বিজ্ঞানী। তাঁর কাজ কারবার ছিলো কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে। বস্তুর অভ্যন্তরে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাদের চরিত্র ব্যাখ্যা করতে হলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্য নিতে হয়।
বিজ্ঞানীরা জানেন বস্তুকণাদের চরিত্র বড়ই অদ্ভুত। চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের সাধারণ নিয়ম এরা মানে না। বস্তুকণারা চলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম অনুসারে। কোয়ান্টাম জগতে একটি বস্তুকণা একই সাথে একাধিক অবস্থানে থাকতে পারে। কোয়ান্টাম বস্তুকণার এই বৈশিষ্ট্যকে বলা হয়,"সুপারপজিশন"। কিন্তু ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, কোয়ান্টাম কণাদের এই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান একইসঙ্গে আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি না। যখনই কোন বস্তুকণাকে পর্যবেক্ষণ করা হয় তখনই তার সুপারপজিশনের অবসান ঘটে। বস্তুকণাদের অবস্থানের ব্যাখ্যা করতে হয় সম্ভাব্যতা বা প্রবাবিলিটি দিয়ে।
শ্রোডিঙ্গার এই কোয়ান্টাম রহস্যকে ব্যাখ্যা করতে ১৯২৬ সালে একটা অসাধারণ গাণিতিক সমীকরণ তৈরি করেছিলেন। এর নাম "ওয়েভ ফাংশন"। এটি একটা পার্শিয়াল ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশন। এটা দিয়ে বোঝা যায়, একটি কণার কোন অবস্থায় থাকার কতটা সম্ভাবনা রয়েছে। এই যুগান্তকারী কাজের জন্য তিনি ১৯৩৩ সালে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন।
ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সে যেভাবে নিউটনের সমীকরণ ব্যবহার করে একটা বল ছুঁড়লে সেটা কোথায় পড়বে তা বোঝা যায়, ঠিক তেমনিভাবেই কণাজগতের গতিপ্রকৃতি বোঝা যায় শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণ থেকে।
কিন্তু শ্রোডিঙ্গার নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন, এই কোয়ান্টাম নিয়ম যদি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে সেটা কতোটা অদ্ভুত হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই চিন্তা থেকেই তিনি মনে মনে একটি পরীক্ষা করলেন, যার নামই হয়ে গেল “শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল”।
মজার ব্যাপার হলো, সত্যিকারের বিড়াল নিয়ে আসলে তিনি কোন পরীক্ষাই করেননি, এটি তাঁর চিন্তা ভাবনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ইংরেজিতে যাকে বলে, থট এক্সপেরিমেন্ট। তিনি তাঁর কাল্পনিক বিড়ালটিকে একটি বাক্সে বন্দি করলেন। বাক্সে খুব অল্প পরিমাণে একটি তেজস্ক্রিয় পদার্থ রাখা হয়েছে, যার হাফ-লাইফ এক ঘণ্টা। এই সময়ে পদার্থটি তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে পারে আবার নাও ছড়াতে পারে। এই বাক্সের মধ্যে তিনি আরো রাখলেন একটি বোতল। যার ভেতরে রাখা আছে তীব্র বিষ সায়ানাইড। সেই সাথে তেজস্ক্রিয়তা মাপার জন্য তিনি একটি গাইগার কাউন্টার যন্ত্রও জুড়ে দিলেন। যন্ত্রটির সাথে একটি হাতুড়ি এমনভাবে রাখা হলো যাতে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে যন্ত্রটির কাঁটা নড়ে উঠলেই হাতুড়িটি গিয়ে পড়বে ঐ বিষের বোতলটির উপর। ফলে বোতল ভেঙ্গে বাক্সের ভেতর সায়ানাইড বিষ ছড়িয়ে পড়বে।সাথে সাথে তীব্র বিষক্রিয়ায় বিড়ালটি মারা যাবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বিড়ালটির জীবন মরণ নির্ভর করছে ঐ সামান্য পরিমাণ তেজস্ক্রিয় পদার্থটির উপর। যে পদার্থটি তেজস্ক্রিয়তা ছড়ালে বিড়ালটি মারা যাবে আর না ছড়ালে বিড়ালটি বেঁচে যাবে। এক্ষেত্রে দুটোরই ফিফটি- ফিফটি সম্ভাবনা রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এক ঘণ্টা পর বাক্সটি যদি কেউ না খোলে, তাহলে বিড়ালটির অবস্থা কী হবে? যেহেতু তেজস্ক্রিয় পদার্থ ক্ষয় হয়েছে এবং হয়নি—এই দুই সম্ভাবনাই সুপারপজিশনে আছে, তাহলে কি বাক্সের ভেতরে বিড়ালটিও একই সঙ্গে জীবিত এবং মৃত—এই দুই অবস্থায় রয়েছে?
কোয়ান্টাম তত্ত্ব যদি ক্ষুদ্র কণার জন্যই প্রযোজ্য হয়, তাহলে বড় মাপের বস্তু, যেমন বিড়ালের ক্ষেত্রেও কি তা খাটবে? শ্রোডিঙ্গারের উদ্দেশ্য ছিল ঠিক এই প্রশ্নটা তোলা। কারণ, বাস্তবে আমরা কখনো কোনো বিড়ালকে একইসঙ্গে জীবিত ও মৃত অবস্থায় দেখতে পাই না! এই থট এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে শ্রোডিঙ্গার দেখাতে চেয়েছিলেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম বস্তুকণাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতে প্রয়োগ করা গেলেও, সেটা যদি আমাদের দৈনন্দিন দৃশ্যমান জগতে টেনে আনা হয়, তবে সেটা বিপজ্জনকভাবে হাস্যকর হয়ে দাঁড়াতে পারে।
শ্রোডিঙ্গারের বিড়ালের এই উদাহরণ আমাদের শেখায়, কোয়ান্টাম বাস্তবতা পুরোটাই সম্ভাবনা নির্ভর। পর্যবেক্ষণের আগ পর্যন্ত কোয়ান্টাম জগতের সবকিছু একসাথে একাধিক অবস্থায় থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের দৃশ্যমান বাস্তব জগতে সেটা সম্ভব নয়। তাহলে কোয়ান্টাম জগত আর ক্লাসিক্যাল জগতের মাঝখানে কোথায় সেই সীমানা? আর সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আজও বিজ্ঞানীরা মাথা ঘামিয়ে চলেছেন।
Comments