বিজ্ঞানী মানেই কি কেবল সাদা অ্যাপ্রন পরে পরীক্ষাগারে কাজ করা একজন নিরস মানুষ? যদি তাই মনে করেন, তাহলে ভেঙ্কটরামণ রামাকৃষ্ণন, যিনি বেশি পরিচিত ভেঙ্কি রামাকৃষ্ণন নামে, তাঁর জীবন আপনাকে নতুন করে ভাবাবে। কারণ, এই মানুষটির জীবন শুধুই গবেষণার গল্প নয়। এটি সংগ্রাম, সাহস আর জ্ঞানের সীমানা পেরোনোর এক অনবদ্য অভিযানের কাহিনী। ২০০৯ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কারজয়ী এই বিজ্ঞানীর পথচলা একেবারে গতানুগতিক নয়। বরং পদার্থবিজ্ঞান থেকে জীববিজ্ঞানে তাঁর ছুটে চলা যেন বিজ্ঞানের ক্যানভাসে আঁকা এক জীবন্ত কবিতা।
ভেঙ্কি রামাকৃষ্ণনের জন্ম ১৯৫২ সালে ভারতের তামিলনাড়ুর চিদাম্বরম শহরে। মা–বাবা দুজনেই ছিলেন বিজ্ঞানী। ছোটবেলা থেকেই তিনি পড়াশোনায় ভালো হলেও, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা তাঁকে টানেনি। তাঁর আগ্রহ ছিল তত্ত্বের গভীরে যাওয়ায়। ভারতের বরোদার মহারাজা সায়াজিরাও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক সম্পন্ন করে মাত্র উনিশ বছর বয়সে তিনি পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে। এরপরেই আসে জীবন বদলে দেওয়া সিদ্ধান্ত। তিনি ঝুঁকে পড়েন জীববিজ্ঞানের দিকে। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, সানডিয়াগোর গ্রাজুয়েট স্কুলে বায়োলজি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। একেবারে নতুন এক জগতে পা রাখলেন তিনি। কিছু বছর পর জীববিজ্ঞানে গবেষণার সুযোগ নিয়ে তিনি পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে, যেখানে তিনি যুক্ত হন বিশ্বখ্যাত MRC Laboratory of Molecular Biology-এর সঙ্গে।
ক্যারিয়ারের শুরুতে জেনেটিক্স আর মলিকুলার বায়োলজি ছিল তাঁর কাছে একেবারে অচেনা ভাষা। কিন্তু অক্লান্ত অধ্যবসায়ে তিনি রপ্ত করেন জীববিদ্যার মৌলিক বিষয়গুলো। পরে এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি নামে এক বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি জীবকোষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, রাইবোসোমের ত্রিমাত্রিক গঠন উন্মোচনে সফল হন।
এই রাইবোসোম হলো জীবকোষের অভ্যন্তরের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রোটিন তৈরির কারখানা। ডিএনএ যেভাবে নির্দেশনা দেয়, রাইবোসোম সেই অনুযায়ী তৈরি করে প্রোটিন, যে উপাদান ছাড়া জীবনই অসম্ভব।
রাইবোসোমের গঠন অত্যন্ত জটিল। এটি মূলত তিনটি রাইবোসোমাল আরএনএ (rRNA) এবং প্রায় ৮০টি রাইবোসোমাল প্রোটিন নিয়ে গঠিত, যার মোট আণবিক ভর কয়েক মিলিয়ন ডাল্টন। এত জটিল গঠন বিশ্লেষণ করা ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।
কিন্তু দীর্ঘ ও সফল গবেষণার মাধ্যমে ভেঙ্কি রামাকৃষ্ণন ও তাঁর সহযোগী বিজ্ঞানীরা ব্যাকটেরিয়াল রাইবোসোমের হাই রেজোলিউশন থ্রি-ডি গঠন আবিষ্কার করতে সমর্থ হন। এটা শুধুমাত্র প্রোটিন সংশ্লেষণের প্রক্রিয়াকেই নয়, সেই সাথে অ্যান্টিবায়োটিক কীভাবে কাজ করে, সেটাও বোঝার পথ খুলে দেয়। কারণ, অনেক অ্যান্টিবায়োটিক সরাসরি রাইবোসোমকে টার্গেট করেই ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধ করে।
এই গবেষণার জন্য ২০০৯ সালে তিনি আদা ইয়োনাথ এবং টমাস স্টেইৎজের সঙ্গে ভাগ করে নেন রসায়নে নোবেল পুরস্কার। এই পুরস্কার শুধু তাঁকেই সম্মানিত করেনি, বরং অভিবাসী গবেষকদের জন্য হয়ে উঠেছে এক অনুপ্রেরণার উৎস।
নোবেল বিজয়ের পর তিনি যুক্তরাজ্যের ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান, এক সময় যেখানে নিউটন, ডারউইন, ম্যাক্সওয়েল ও হকিংয়ের পদচিহ্ন রয়ে গেছে। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। এটি ছিল একধরনের প্রতীকী বিজয়, বিশেষ করে অভিবাসী বিজ্ঞানীদের জন্য।
তাঁর লেখা আত্মজীবনীমূলক বই "Gene Machine: The Race to Decipher the Secrets of the Ribosome" এক চমৎকার কাহিনি। এটি শুধু এক বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের গল্প নয়, বরং এক ব্যক্তিগত যুদ্ধের বিবরণ। যেখানে বৈজ্ঞানিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সন্দেহ, আবেগ আর কৌতূহল সব একসঙ্গে ধরা পড়েছে। এই বইয়ে আমরা জানতে পারি, বিজ্ঞান মানে কেবল কঠিন কিছু সমীকরণ নয়, বরং এটি মানুষের আবেগ, কষ্ট, সৃজনশীলতা এবং আত্মজয় করার এক উপাখ্যান।
বর্তমানে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের MRC Laboratory of Molecular Biology-তে যুক্ত আছেন। কোভিড-১৯ মহামারির সময়েও তিনি জনসচেতনতা তৈরি, ভ্যাকসিন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক কথাবার্তা চালিয়ে গেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি জিন এডিটিং, রাইবোসোমাল মিউটেশন ও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করে চলেছেন।
আজ ভেঙ্কি রামাকৃষ্ণন শুধুমাত্র একজন সফল বিজ্ঞানীর নাম নয়, তিনি তরুণ বিজ্ঞানীদের জন্য এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়, ভিন্ন পথে হাঁটার সাহস থাকলেই সাফল্য ধরা দেয়। তিনি প্রমাণ করেছেন, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন আর জীববিজ্ঞান—এসব একে অপরের সীমানায় বাঁধা নয়; বরং একসঙ্গে মিলে গড়ে তোলে আমাদের এই বিস্ময়কর জগতকে বোঝার চাবিকাঠি।
এটাই ভেঙ্কি রামাকৃষ্ণনের বিজ্ঞান। যে বিজ্ঞান সীমাবদ্ধ নয় কেবল গবেষণাগার বা পুরস্কারে, বরং ছড়িয়ে আছে প্রতিটি সাহসী চিন্তায়, প্রতিটি নতুন কৌতূহলে।
ছবি কৃতজ্ঞতা: উইকিপিডিয়া
Comments