আদিকাল থেকেই মানুষের মনে হয়েছে এই মহাবিশ্বে সে একা নয়। রাতের আকাশে অসংখ্য তারার ভিড়ে দাঁড়িয়ে আদিম মানব একবার হলেও ভেবেছিল—আমি কি একা? অসংখ্য তারার মেলা দেখে সে বিস্ময়ে হতবাক হয়েছে। তারকামণ্ডলীর আকৃতিকে সে কল্পনা করেছে বিভিন্ন প্রাণীর চেহারায়। রাশিচক্রে তাই প্রাণীর আধিক্য এতো বেশি। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাসের মনে হয়েছিল, মহাশূন্যের ওপারে অসংখ্য ছোট বড় জগৎ রয়েছে, তার কোনো কোনোটি প্রাণের স্পন্দনে মুখরিত হতে পারে। এর চারশো বছর পর রোমান দার্শনিক ও কবি লুক্রেটিয়াস অন্য জগতের কথা লিখেছিলেন। সেখানে ভিন্নধরনের মানুষ এবং প্রাণীর কল্পনাও তিনি করেছিলেন।
কল্পবিজ্ঞানের জন্ম:
মহাবিশ্বে মানব সভ্যতার চেয়ে উন্নত কোনো সভ্যতার অস্তিত্ব থাকতে পারে—এই ধারণা আদিম কৌতূহলেরই এক বৈজ্ঞানিক রূপ। সেই কল্পনা থেকেই জন্ম নিয়েছে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি বা সায়েন্স ফিকশন। সপ্তদশ শতাব্দীতে জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইয়োহান্স কেপলার লেখেন Somnium নামের একটি গল্প যেখানে একজন চরিত্র চাঁদে গিয়ে বিচিত্র সব সরীসৃপের পাল্লায় পড়ে। এটিকে অনেকেই পৃথিবীর প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি হিসেবে গণ্য করেন।
ওই শতাব্দীর শেষদিকে ডাচ গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান হাইগেন্স তাঁর Cosmotheoros গ্রন্থে লিখেছিলেন, মহাবিশ্বে অন্যান্য গ্রহেও প্রাণের সম্ভাবনা থাকতে পারে। তিনি এমনকি ভিন্ন গ্রহের অধিবাসীদের আকার-আকৃতি, সংস্কৃতি এবং চিন্তা-ভাবনার কল্পনাও করেছিলেন। এই সব লেখাই ভবিষ্যতের কল্পবিজ্ঞানের ভিত্তি তৈরি করে দেয়, যা একসময় বিজ্ঞান ও কল্পনার সংমিশ্রণে মানুষের কল্পনার সীমানা প্রসারিত করে।
বিজ্ঞানের হাত ধরে অনুসন্ধান:
১৮৯৪ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী পার্সিভাল লয়েল তাঁর টেলিস্কোপ দিয়ে মঙ্গলগ্রহ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে অদ্ভুত এক ব্যাপার লক্ষ্য করলেন। তিনি দেখলেন, মঙ্গলের বুকে আড়াআড়ি কিছু দাগ দেখা যাচ্ছে। তাঁর মনে হলো, এগুলো প্রাকৃতিক নয়, বরং এগুলো মঙ্গলগ্রহের "অধিবাসীদের" সৃষ্টি করা খাল। তিনি বললেন, এগুলো তারা কৃষিকাজের জন্য তৈরি করেছে। সে সময় পার্সিভালের ধারণাটি ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। পরবর্তীতে অবশ্য আরও শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করার ফলে তাঁর ধারণাটি ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়।
পৃথিবী ছাড়াও অন্য কোনো গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে—এটা অনেক প্রাচীন ধারণা। বিংশ শতাব্দীতে এসে এই ধারণাটি একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি লাভ করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে মানুষ এখন মহাকাশে নভোযান পাঠাচ্ছে। চাঁদ থেকে শিলাখণ্ড সংগ্রহ করে এনেছে। মঙ্গল গ্রহে পাঠিয়েছে একাধিক রোবোটিক যান। সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহেই মানুষের তৈরি নভোযান পৌঁছে গেছে। চাঁদ এবং মঙ্গলে জমাট পানির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপাতেও পানির অস্তিত্ব মিলেছে। অনেক উল্কাখণ্ডের মধ্যে অ্যামাইনো অ্যাসিডের সন্ধান পাওয়া গেছে। শক্তিশালী অপটিক্যাল এবং রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করে আমাদের সৌরজগতের বাইরেও পৃথিবীর মতো আরও অনেক গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে। মানুষ আস্তে আস্তে মহাবিশ্বকে বুঝতে শিখেছে, বুঝতে পেরেছে এর বিশালত্বকে। কিন্তু এত কিছুর পরেও পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও প্রাণের অস্তিত্বের নিশ্চিত প্রমাণ মেলেনি।
ড্রেক সমীকরণ ও কার্ডাশেভ স্কেল:
তবুও বিজ্ঞানীরা হাল ছাড়ার পাত্র নন। মহাকাশে প্রাণের সন্ধান অব্যাহত রয়েছে। এই অনুসন্ধান মূলত দু'ধরনের—প্রথমত, তাঁরা দেখছেন চাঁদ বা সৌরজগতের কোনো গ্রহে কোনো অণুজীবের অস্তিত্ব রয়েছে কি না। দ্বিতীয়ত, তাঁরা খুঁজছেন সৌরজগতের বাইরে কোথাও কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব। যদি এমন প্রাণী থাকে, তাহলে তারা কেমন সভ্যতা গড়ে তুলেছে সেটাও তাঁদের গবেষণার বিষয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মহাবিশ্ব এত বিশাল যে সেখানে একাধিক উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব থাকা স্বাভাবিক। পৃথিবীতে যে নিয়মে প্রাণের উন্মেষ ঘটেছে, তা অন্য গ্রহেও ঘটতে পারে। বিবর্তনের ধারায় সেখানে উন্নত সভ্যতা গড়ে ওঠাও অস্বাভাবিক নয়।
১৯৬৪ সালে রাশিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী নিকোলাই কার্ডাশেভ সভ্যতাগুলোর শ্রেণিবিন্যাস করেন তাদের শক্তি ব্যবহারের ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে। তিনি তিনটি স্তরের সভ্যতার কথা বলেন—প্রথম, যারা নিজের গ্রহে এসে পৌঁছানো শক্তি ব্যবহার করে; দ্বিতীয়, যারা তাদের নিকটবর্তী নক্ষত্র থেকে সম্পূর্ণ শক্তি আহরণ করতে পারে; তৃতীয়, যারা তাদের গ্যালাক্সির সমস্ত শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে। তাঁর এই শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী, পৃথিবীর মানুষ এখনো প্রথম ধাপের নিচে অবস্থান করছে। বর্তমানে অবশ্য এই শ্রেণিবিন্যাসকে সম্প্রসারিত করে সাতটি স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সবচেয়ে উচ্চস্তরের সভ্যতা এমন, যারা সময় ও স্থানকে অতিক্রম করে মহাবিশ্বকে নিজের মতো করে গড়ে তুলতে পারে। এসব ধারণা এখনো অনুমানের পর্যায়ে রয়েছে; এর পক্ষে কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ এখনও মেলেনি।
ষাটের দশকের শুরুতে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক ড্রেক একটি সমীকরণের সাহায্যে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে কত সংখ্যক উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব থাকতে পারে, তার একটি ধারণা দেন। একে বলা হয় ড্রেক সমীকরণ। এই সমীকরণে বেশ কিছু প্যারামিটার রয়েছে, যেগুলোর মান পরিবর্তন করে বিভিন্ন সংখ্যার অনুমান পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হলো, এই সংখ্যাটি কয়েক হাজার থেকে কয়েক মিলিয়নের মধ্যে যেকোনো কিছু হতে পারে।
প্রকল্প SETI থেকে ব্রেকথ্রু লিসেন:
অপর সভ্যতার সন্ধানে ড্রেক একটি সাহসী পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর রেডিও টেলিস্কোপটি তাক করলেন সূর্যের মতো সাইজের দুটি নক্ষত্রের দিকে। তিনি বেছে নিলেন ১৪২০ মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সি—যেখানে শীতল হাইড্রোজেন গ্যাস থেকে সৃষ্ট সংকেত ধরা পড়ে, কারণ মহাবিশ্বে হাইড্রোজেনই সবচেয়ে প্রচুর মৌল। তাঁর যুক্তি ছিল, অন্য কোনও উন্নত সভ্যতা যদি যোগাযোগ করতে চায়, এই ফ্রিকোয়েন্সিই তাদের পছন্দ হবে। বলাই বাহুল্য, ড্রেক তাঁর পরীক্ষায় সফল হননি। কিন্তু এখান থেকেই জন্ম নেয় এক ঐতিহাসিক প্রকল্প—"সার্চ ফর এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স" বা সংক্ষেপে প্রজেক্ট সেটি (Project SETI)। এই প্রকল্পে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত বিশাল বিশাল রেডিও টেলিস্কোপ দিয়ে মহাশূন্যে খোঁজা হয়েছে ভিন্ন কোনো সভ্যতার সংকেত। তবে নিশ্চিত করে কিছু পাওয়া যায়নি।
তবে ১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিও টেলিস্কোপে ৭২ সেকেন্ডের একটি রহস্যময় সংকেত ধরা পড়েছিল। সংকেতটির উৎস ছিল স্যাজিটারিয়াস নক্ষত্রপুঞ্জ। কম্পিউটার প্রিন্ট আউটের পাশে সংশ্লিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী লাল কালি দিয়ে বড় অক্ষরে লিখে ফেলেছিলেন—"Wow!"। বলাই বাহুল্য, তিনি এতটাই বিস্মিত হয়েছিলেন। আজও এই সংকেতের কোনো নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা মেলেনি। যদিও নানা তত্ত্ব প্রচলিত আছে। ইদানিং বিজ্ঞানীরা শুধু রেডিও নয়, লেজার রশ্মিরও সন্ধান করছেন। কারও কারও মতে, উন্নত সভ্যতা আমাদের সাথে যোগাযোগের জন্য লেজার রশ্মিও ব্যবহার করতে পারে।
২০১৬ সালে ইউরি মিলনার নামে এক বিলিয়নিয়ার উদ্যোক্তা ব্রেকথ্রু লিসেন (Breakthrough Listen) নামে ১০০ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প হাতে নেন। এই প্রকল্পের আওতায় পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে রেডিও টেলিস্কোপ দিয়ে মহাশূন্যের বিভিন্ন অংশ তন্নতন্ন করে খোঁজা হচ্ছে অন্য কোনও সভ্যতার বেতার সংকেতের সন্ধানে।
প্রক্সিমা বি এর রেডিও সংকেত:
২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্রেকথ্রু লিসেন প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের পার্কস রেডিও টেলিস্কোপে একটি রহস্যময় রেডিও সিগন্যাল রেকর্ড হয়েছে। এর ফ্রিকোয়েন্সি ছিল ৯৮২.০০২ মেগাহার্টজ। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, এই সংকেত এসেছে সূর্যের সবচেয়ে নিকটবর্তী নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টরাই থেকে। এই নক্ষত্রটিকে ঘিরে ঘুরছে একটি গ্রহ—প্রক্সিমা বি। পৃথিবী থেকে যার দূরত্ব সাড়ে চার আলোকবর্ষ। তবে এই সংকেতটি কেবল একবারই ধরা পড়েছে। পরবর্তীতে ২০২১ সালে বিশ্লেষণে দেখা যায়, এটি আসলে মানুষের তৈরি যন্ত্রপাতি থেকে আসা হস্তক্ষেপ। এটি কোনো টেকনো-সিগনেচার ছিল না।
তবে গবেষণা এখানেই থেমে থাকেনি। ২০২২ সালে ব্রেকথ্রু লিসেন প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে কিছু নতুন সংকেত শনাক্ত করেছেন, যেগুলো আরও বিশ্লেষণের অপেক্ষায় রয়েছে। এসব সংকেতের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু জানা না গেলেও, এ থেকে বোঝা যায় প্রযুক্তি ও পদ্ধতির বিকাশের সাথে সাথে সন্ধানের পরিধিও বাড়ছে।
রসওয়েলের ইউএফও এবং মেক্সিকোর মমি রহস্য:
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর ছোট শহর রসওয়েলে এক রহস্যময় ঘটনা ঘটে যা আজও ইউএফও (UFO) আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। সেই সময় রসওয়েলের এক খামারমালিক তাঁর জমিতে ধ্বংসস্তূপের মতো কিছু অদ্ভুত ধাতব বস্তু খুঁজে পান। স্থানীয় সেনাঘাঁটি প্রথমে এক বিবৃতিতে জানায়, তারা একটি “ফ্লাইং ডিস্ক” উদ্ধার করেছে। এই খবরটি মুহূর্তেই মিডিয়ায় তোলপাড় ফেলে দেয়। কিন্তু পরদিনই সেই বিবৃতি বদলে বলা হয়, বস্তুটি ছিল একটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ বেলুন।
এই হঠাৎ ঘুরে যাওয়া বক্তব্যকে ঘিরে জন্ম নেয় নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। অনেকে মনে করেন, সেটি আদতে একটি ভিনগ্রহী যান ছিল, আর মার্কিন সরকার ঘটনাটি গোপন করতে চেয়েছিল। পরে ১৯৯০-এর দশকে মার্কিন বিমান বাহিনী দাবি করে, সেটি ছিল “প্রজেক্ট মুঘল” নামের এক গোপন নজরদারি প্রকল্পের অংশ। কিন্তু ইউএফও গবেষকদের একাংশ এখনো বিশ্বাস করেন, রসওয়েল ছিল মানুষের ইতিহাসে ভিনগ্রহী জীবনের প্রথম প্রত্যক্ষ প্রমাণ—যা চিরকাল চাপা পড়ে গেছে।
আবার ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মেক্সিকোর কংগ্রেসে এক ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ঘটে। সাংবাদিক ও ইউএফও গবেষক জাইমে মাউসান সেখানে দুটি ছোট মমি প্রদর্শন করেন, যেগুলো তিনি দাবি করেন ভিনগ্রহী প্রাণীর দেহাবশেষ। তিনি বলেন, এই মমিগুলো প্রায় ১,০০০ বছর পুরোনো এবং পেরুর একটি গুহা থেকে পাওয়া গেছে। যদিও এই দাবিগুলি ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলেও, অনেক বিজ্ঞানী একে সন্দেহের চোখে দেখেছেন এবং ধারণা করেন এগুলো মানুষের তৈরি শিল্পকর্ম বা কৃত্রিমভাবে তৈরি বস্তু। বিষয়টি আজও বিতর্কিত।
যুগ সন্ধিক্ষণ
আপনি হয়তো মনে মনে ভাবছেন, আচ্ছা, সত্যিই কি কেউ আছে সেখানে? যারা আমাদের পাঠানো রেডিও সিগন্যালের প্রতীক্ষায় মহাশূন্যের অন্য প্রান্তে বসে আছে?
এই প্রশ্নটাই মানুষের এখনো অজানা। আমরা জানি না উত্তরটা কী হতে পারে, তবুও মানুষ খুঁজে যাচ্ছে। এই খোঁজ শুধুমাত্র অপর সভ্যতার সন্ধানে নয়। এটা আমাদের আত্মপরিচয়ের, আমাদের সীমাহীন কৌতূহলের প্রতিফলন। হয়তো একদিন, কোনো এক সুদূর নক্ষত্রের প্রান্ত থেকে ভেসে আসবে একটি আশ্চর্য সংকেত, অপর কোনো সভ্যতার পাঠানো প্রথম সম্ভাষণ। আর সেই যোগাযোগের যুগ সন্ধিক্ষণেই বদলে যাবে মানব সভ্যতার ইতিহাস, মহাবিশ্বে প্রসারিত হবে আমাদের চেতনার সীমানা।
© তানভীর হোসেন
কল্পবিজ্ঞানের জন্ম:
মহাবিশ্বে মানব সভ্যতার চেয়ে উন্নত কোনো সভ্যতার অস্তিত্ব থাকতে পারে—এই ধারণা আদিম কৌতূহলেরই এক বৈজ্ঞানিক রূপ। সেই কল্পনা থেকেই জন্ম নিয়েছে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি বা সায়েন্স ফিকশন। সপ্তদশ শতাব্দীতে জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইয়োহান্স কেপলার লেখেন Somnium নামের একটি গল্প যেখানে একজন চরিত্র চাঁদে গিয়ে বিচিত্র সব সরীসৃপের পাল্লায় পড়ে। এটিকে অনেকেই পৃথিবীর প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি হিসেবে গণ্য করেন।
ওই শতাব্দীর শেষদিকে ডাচ গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান হাইগেন্স তাঁর Cosmotheoros গ্রন্থে লিখেছিলেন, মহাবিশ্বে অন্যান্য গ্রহেও প্রাণের সম্ভাবনা থাকতে পারে। তিনি এমনকি ভিন্ন গ্রহের অধিবাসীদের আকার-আকৃতি, সংস্কৃতি এবং চিন্তা-ভাবনার কল্পনাও করেছিলেন। এই সব লেখাই ভবিষ্যতের কল্পবিজ্ঞানের ভিত্তি তৈরি করে দেয়, যা একসময় বিজ্ঞান ও কল্পনার সংমিশ্রণে মানুষের কল্পনার সীমানা প্রসারিত করে।
বিজ্ঞানের হাত ধরে অনুসন্ধান:
১৮৯৪ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী পার্সিভাল লয়েল তাঁর টেলিস্কোপ দিয়ে মঙ্গলগ্রহ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে অদ্ভুত এক ব্যাপার লক্ষ্য করলেন। তিনি দেখলেন, মঙ্গলের বুকে আড়াআড়ি কিছু দাগ দেখা যাচ্ছে। তাঁর মনে হলো, এগুলো প্রাকৃতিক নয়, বরং এগুলো মঙ্গলগ্রহের "অধিবাসীদের" সৃষ্টি করা খাল। তিনি বললেন, এগুলো তারা কৃষিকাজের জন্য তৈরি করেছে। সে সময় পার্সিভালের ধারণাটি ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। পরবর্তীতে অবশ্য আরও শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করার ফলে তাঁর ধারণাটি ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়।
পৃথিবী ছাড়াও অন্য কোনো গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে—এটা অনেক প্রাচীন ধারণা। বিংশ শতাব্দীতে এসে এই ধারণাটি একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি লাভ করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে মানুষ এখন মহাকাশে নভোযান পাঠাচ্ছে। চাঁদ থেকে শিলাখণ্ড সংগ্রহ করে এনেছে। মঙ্গল গ্রহে পাঠিয়েছে একাধিক রোবোটিক যান। সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহেই মানুষের তৈরি নভোযান পৌঁছে গেছে। চাঁদ এবং মঙ্গলে জমাট পানির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপাতেও পানির অস্তিত্ব মিলেছে। অনেক উল্কাখণ্ডের মধ্যে অ্যামাইনো অ্যাসিডের সন্ধান পাওয়া গেছে। শক্তিশালী অপটিক্যাল এবং রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করে আমাদের সৌরজগতের বাইরেও পৃথিবীর মতো আরও অনেক গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে। মানুষ আস্তে আস্তে মহাবিশ্বকে বুঝতে শিখেছে, বুঝতে পেরেছে এর বিশালত্বকে। কিন্তু এত কিছুর পরেও পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও প্রাণের অস্তিত্বের নিশ্চিত প্রমাণ মেলেনি।
ড্রেক সমীকরণ ও কার্ডাশেভ স্কেল:
তবুও বিজ্ঞানীরা হাল ছাড়ার পাত্র নন। মহাকাশে প্রাণের সন্ধান অব্যাহত রয়েছে। এই অনুসন্ধান মূলত দু'ধরনের—প্রথমত, তাঁরা দেখছেন চাঁদ বা সৌরজগতের কোনো গ্রহে কোনো অণুজীবের অস্তিত্ব রয়েছে কি না। দ্বিতীয়ত, তাঁরা খুঁজছেন সৌরজগতের বাইরে কোথাও কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব। যদি এমন প্রাণী থাকে, তাহলে তারা কেমন সভ্যতা গড়ে তুলেছে সেটাও তাঁদের গবেষণার বিষয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মহাবিশ্ব এত বিশাল যে সেখানে একাধিক উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব থাকা স্বাভাবিক। পৃথিবীতে যে নিয়মে প্রাণের উন্মেষ ঘটেছে, তা অন্য গ্রহেও ঘটতে পারে। বিবর্তনের ধারায় সেখানে উন্নত সভ্যতা গড়ে ওঠাও অস্বাভাবিক নয়।
১৯৬৪ সালে রাশিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী নিকোলাই কার্ডাশেভ সভ্যতাগুলোর শ্রেণিবিন্যাস করেন তাদের শক্তি ব্যবহারের ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে। তিনি তিনটি স্তরের সভ্যতার কথা বলেন—প্রথম, যারা নিজের গ্রহে এসে পৌঁছানো শক্তি ব্যবহার করে; দ্বিতীয়, যারা তাদের নিকটবর্তী নক্ষত্র থেকে সম্পূর্ণ শক্তি আহরণ করতে পারে; তৃতীয়, যারা তাদের গ্যালাক্সির সমস্ত শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে। তাঁর এই শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী, পৃথিবীর মানুষ এখনো প্রথম ধাপের নিচে অবস্থান করছে। বর্তমানে অবশ্য এই শ্রেণিবিন্যাসকে সম্প্রসারিত করে সাতটি স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সবচেয়ে উচ্চস্তরের সভ্যতা এমন, যারা সময় ও স্থানকে অতিক্রম করে মহাবিশ্বকে নিজের মতো করে গড়ে তুলতে পারে। এসব ধারণা এখনো অনুমানের পর্যায়ে রয়েছে; এর পক্ষে কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ এখনও মেলেনি।
ষাটের দশকের শুরুতে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক ড্রেক একটি সমীকরণের সাহায্যে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে কত সংখ্যক উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব থাকতে পারে, তার একটি ধারণা দেন। একে বলা হয় ড্রেক সমীকরণ। এই সমীকরণে বেশ কিছু প্যারামিটার রয়েছে, যেগুলোর মান পরিবর্তন করে বিভিন্ন সংখ্যার অনুমান পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হলো, এই সংখ্যাটি কয়েক হাজার থেকে কয়েক মিলিয়নের মধ্যে যেকোনো কিছু হতে পারে।
প্রকল্প SETI থেকে ব্রেকথ্রু লিসেন:
অপর সভ্যতার সন্ধানে ড্রেক একটি সাহসী পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর রেডিও টেলিস্কোপটি তাক করলেন সূর্যের মতো সাইজের দুটি নক্ষত্রের দিকে। তিনি বেছে নিলেন ১৪২০ মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সি—যেখানে শীতল হাইড্রোজেন গ্যাস থেকে সৃষ্ট সংকেত ধরা পড়ে, কারণ মহাবিশ্বে হাইড্রোজেনই সবচেয়ে প্রচুর মৌল। তাঁর যুক্তি ছিল, অন্য কোনও উন্নত সভ্যতা যদি যোগাযোগ করতে চায়, এই ফ্রিকোয়েন্সিই তাদের পছন্দ হবে। বলাই বাহুল্য, ড্রেক তাঁর পরীক্ষায় সফল হননি। কিন্তু এখান থেকেই জন্ম নেয় এক ঐতিহাসিক প্রকল্প—"সার্চ ফর এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স" বা সংক্ষেপে প্রজেক্ট সেটি (Project SETI)। এই প্রকল্পে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত বিশাল বিশাল রেডিও টেলিস্কোপ দিয়ে মহাশূন্যে খোঁজা হয়েছে ভিন্ন কোনো সভ্যতার সংকেত। তবে নিশ্চিত করে কিছু পাওয়া যায়নি।
তবে ১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিও টেলিস্কোপে ৭২ সেকেন্ডের একটি রহস্যময় সংকেত ধরা পড়েছিল। সংকেতটির উৎস ছিল স্যাজিটারিয়াস নক্ষত্রপুঞ্জ। কম্পিউটার প্রিন্ট আউটের পাশে সংশ্লিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী লাল কালি দিয়ে বড় অক্ষরে লিখে ফেলেছিলেন—"Wow!"। বলাই বাহুল্য, তিনি এতটাই বিস্মিত হয়েছিলেন। আজও এই সংকেতের কোনো নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা মেলেনি। যদিও নানা তত্ত্ব প্রচলিত আছে। ইদানিং বিজ্ঞানীরা শুধু রেডিও নয়, লেজার রশ্মিরও সন্ধান করছেন। কারও কারও মতে, উন্নত সভ্যতা আমাদের সাথে যোগাযোগের জন্য লেজার রশ্মিও ব্যবহার করতে পারে।
২০১৬ সালে ইউরি মিলনার নামে এক বিলিয়নিয়ার উদ্যোক্তা ব্রেকথ্রু লিসেন (Breakthrough Listen) নামে ১০০ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প হাতে নেন। এই প্রকল্পের আওতায় পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে রেডিও টেলিস্কোপ দিয়ে মহাশূন্যের বিভিন্ন অংশ তন্নতন্ন করে খোঁজা হচ্ছে অন্য কোনও সভ্যতার বেতার সংকেতের সন্ধানে।
প্রক্সিমা বি এর রেডিও সংকেত:
২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্রেকথ্রু লিসেন প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের পার্কস রেডিও টেলিস্কোপে একটি রহস্যময় রেডিও সিগন্যাল রেকর্ড হয়েছে। এর ফ্রিকোয়েন্সি ছিল ৯৮২.০০২ মেগাহার্টজ। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, এই সংকেত এসেছে সূর্যের সবচেয়ে নিকটবর্তী নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টরাই থেকে। এই নক্ষত্রটিকে ঘিরে ঘুরছে একটি গ্রহ—প্রক্সিমা বি। পৃথিবী থেকে যার দূরত্ব সাড়ে চার আলোকবর্ষ। তবে এই সংকেতটি কেবল একবারই ধরা পড়েছে। পরবর্তীতে ২০২১ সালে বিশ্লেষণে দেখা যায়, এটি আসলে মানুষের তৈরি যন্ত্রপাতি থেকে আসা হস্তক্ষেপ। এটি কোনো টেকনো-সিগনেচার ছিল না।
তবে গবেষণা এখানেই থেমে থাকেনি। ২০২২ সালে ব্রেকথ্রু লিসেন প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে কিছু নতুন সংকেত শনাক্ত করেছেন, যেগুলো আরও বিশ্লেষণের অপেক্ষায় রয়েছে। এসব সংকেতের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু জানা না গেলেও, এ থেকে বোঝা যায় প্রযুক্তি ও পদ্ধতির বিকাশের সাথে সাথে সন্ধানের পরিধিও বাড়ছে।
রসওয়েলের ইউএফও এবং মেক্সিকোর মমি রহস্য:
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর ছোট শহর রসওয়েলে এক রহস্যময় ঘটনা ঘটে যা আজও ইউএফও (UFO) আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। সেই সময় রসওয়েলের এক খামারমালিক তাঁর জমিতে ধ্বংসস্তূপের মতো কিছু অদ্ভুত ধাতব বস্তু খুঁজে পান। স্থানীয় সেনাঘাঁটি প্রথমে এক বিবৃতিতে জানায়, তারা একটি “ফ্লাইং ডিস্ক” উদ্ধার করেছে। এই খবরটি মুহূর্তেই মিডিয়ায় তোলপাড় ফেলে দেয়। কিন্তু পরদিনই সেই বিবৃতি বদলে বলা হয়, বস্তুটি ছিল একটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ বেলুন।
এই হঠাৎ ঘুরে যাওয়া বক্তব্যকে ঘিরে জন্ম নেয় নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। অনেকে মনে করেন, সেটি আদতে একটি ভিনগ্রহী যান ছিল, আর মার্কিন সরকার ঘটনাটি গোপন করতে চেয়েছিল। পরে ১৯৯০-এর দশকে মার্কিন বিমান বাহিনী দাবি করে, সেটি ছিল “প্রজেক্ট মুঘল” নামের এক গোপন নজরদারি প্রকল্পের অংশ। কিন্তু ইউএফও গবেষকদের একাংশ এখনো বিশ্বাস করেন, রসওয়েল ছিল মানুষের ইতিহাসে ভিনগ্রহী জীবনের প্রথম প্রত্যক্ষ প্রমাণ—যা চিরকাল চাপা পড়ে গেছে।
আবার ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মেক্সিকোর কংগ্রেসে এক ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ঘটে। সাংবাদিক ও ইউএফও গবেষক জাইমে মাউসান সেখানে দুটি ছোট মমি প্রদর্শন করেন, যেগুলো তিনি দাবি করেন ভিনগ্রহী প্রাণীর দেহাবশেষ। তিনি বলেন, এই মমিগুলো প্রায় ১,০০০ বছর পুরোনো এবং পেরুর একটি গুহা থেকে পাওয়া গেছে। যদিও এই দাবিগুলি ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলেও, অনেক বিজ্ঞানী একে সন্দেহের চোখে দেখেছেন এবং ধারণা করেন এগুলো মানুষের তৈরি শিল্পকর্ম বা কৃত্রিমভাবে তৈরি বস্তু। বিষয়টি আজও বিতর্কিত।
যুগ সন্ধিক্ষণ
আপনি হয়তো মনে মনে ভাবছেন, আচ্ছা, সত্যিই কি কেউ আছে সেখানে? যারা আমাদের পাঠানো রেডিও সিগন্যালের প্রতীক্ষায় মহাশূন্যের অন্য প্রান্তে বসে আছে?
এই প্রশ্নটাই মানুষের এখনো অজানা। আমরা জানি না উত্তরটা কী হতে পারে, তবুও মানুষ খুঁজে যাচ্ছে। এই খোঁজ শুধুমাত্র অপর সভ্যতার সন্ধানে নয়। এটা আমাদের আত্মপরিচয়ের, আমাদের সীমাহীন কৌতূহলের প্রতিফলন। হয়তো একদিন, কোনো এক সুদূর নক্ষত্রের প্রান্ত থেকে ভেসে আসবে একটি আশ্চর্য সংকেত, অপর কোনো সভ্যতার পাঠানো প্রথম সম্ভাষণ। আর সেই যোগাযোগের যুগ সন্ধিক্ষণেই বদলে যাবে মানব সভ্যতার ইতিহাস, মহাবিশ্বে প্রসারিত হবে আমাদের চেতনার সীমানা।
© তানভীর হোসেন
Comments