হাবল টেনশন ও মহাজাগতিক গরমিলের গল্প

মহাবিশ্ব অবিরাম ছুটে চলেছে। প্রতিটি ছায়াপথ, প্রতিটি তারা, আমাদের দৃষ্টির আড়ালে যেন প্রতিনিয়ত পালিয়ে যাচ্ছে অজানা এক গন্তব্যের দিকে। এই ছুটে চলাকে ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হয় 'হাবল ধ্রুবক'। এটা এমন একটি সংখ্যা, যেটা বলে দেয়, মহাবিশ্ব কত দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হলো, এই 'ধ্রুবক' সংখ্যাটি সব ক্ষেত্রে এক নয়। এটার পরিমাপ একেক ভাবে একেক রকম আসছে। আর এখানেই শুরু হয়েছে বৈজ্ঞানিক জগতে সবচেয়ে রহস্যময় একটি দ্বন্দ্ব—যার নাম, হাবল টেনশন।

এই টেনশন আসলে দুইটি ভিন্ন ভিন্ন গবেষণা পদ্ধতির ফলাফলের অসংগতির মধ্যে দেখা যায়। প্রথম পদ্ধতিতে, বিজ্ঞানীরা ফিরে তাকাচ্ছেন সুদূর অতীতের দিকে। প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগের মহাবিশ্বের শিশুকালীন সময়ের দিকে। এই সময়ের তথ্য পাওয়া যায় এক ধরনের অতিপ্রাচীন বিকিরনের মাধ্যমে, যাকে বলে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন, সংক্ষেপে সিএমবি। এই বিকিরণ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখছেন, হাবল ধ্রুবকের মান দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৬৭ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড প্রতি মেগা-পারসেক।

অন্যদিকে, আধুনিক মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হার পরিমাপ করতে বিজ্ঞানীরা নির্ভর করছেন সেফেইড ভেরিয়েবল তারকা ও সুপারনোভা পর্যবেক্ষণের উপর। এগুলোর উজ্জ্বলতা ও দূরত্বের মধ্যে নিখুঁত সম্পর্ক থাকায়, এগুলোকে বলা হয় 'কসমিক মাইলমার্কার'। এদের সাহায্যে মহাবিশ্বের বর্তমান বিস্তারের হার নির্ধারণ করা হলে দেখা যায়, হাবল ধ্রুবকের মান দাঁড়ায় প্রায় ৭৩ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড প্রতি মেগা-পারসেক।

এখানেই রহস্য। দুটি পদ্ধতি যদি সঠিক হয়, তাহলে সংখ্যাগুলি কেন মিলছে না? আর এই অমিল তো ছোটখাটো পার্থক্য নয়। প্রায় ৯% পার্থক্য! এর মানে দাঁড়ায়, হয় আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে ধারণা সঠিক নয়, নয়তো কসমোলজির সৃষ্টিতত্ত্বে কোথাও বড় ধরণের গরমিল রয়ে গেছে।

বিজ্ঞানীরা এটিকে শুধুই পরিমাপের ত্রুটি বলে পাশ কাটিয়ে যেতে পারছেন না। কারণ, বারবার নির্ভুল পরিমাপেও এই ফাঁকটা থেকেই যাচ্ছে। তাই কেউ কেউ মনে করছেন, আমরা হয়তো নতুন ধরনের পদার্থবিজ্ঞান বা নিউ ফিজিক্সের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। হতে পারে, গ্যালাক্সির প্রসারণে কোনো অজানা শক্তি কাজ করছে, যাকে আমরা এখনো চিনতে পারিনি। আবার কারো মতে, ডার্ক এনার্জি বা ডার্ক ম্যাটারের চরিত্র নিয়ে আমাদের প্রচলিত ধারণাই হয়তো এখনো অসম্পূর্ণ।

এই রহস্য সমাধানে এখন যুক্ত হয়েছে নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ, ইউরোপের ইউক্লিড মিশন, আর সামনের দিনে আসছে আরও শক্তিশালী মহাকাশ পর্যবেক্ষক যন্ত্র।  হয়তো এরা একদিন আমাদের জানাবে, কোনটা সত্যি, কোনটা ভ্রান্ত।

হাবল টেনশন আজ শুধু একটি সংখ্যা বা পার্থক্যের নাম নয়। এই রহস্যই আজকের জ্যোতির্বিজ্ঞানের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর অধ্যায়। এটি মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বোধের সীমা ও সম্ভাবনার মাপকাঠি। হয়তো এই টেনশন আমাদের টেনে নিয়ে যাবে এমন জায়গায়, যেখানে মহাবিশ্বের এক অজানা অধ্যায় খুলে যাবে চোখের সামনে। আর তখন আমরা বুঝবো, এই ছুটে চলা কেবল মহাবিশ্বের নয়, আমাদের জানার পথও ততটাই বিস্তৃত -অবিরাম এবং অন্তহীন।


Comments