রামানুজনের রহস্যনামা


১৯২০ সালের জানুয়ারি মাস। কেমব্রিজের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে পৃথিবী হারাল গণিতের বরপুত্র শ্রীনিবাস রামানুজনকে। মাত্র ৩২ বছর বয়সে নিভে গেল এক কিংবদন্তি প্রতিভার জীবন প্রদীপ। তাঁর অকালমৃত্যুর পর, ব্যক্তিগত নথিপত্রের ভেতরে খুঁজে পাওয়া গেল হাতে লেখা জটিল সব গাণিতিক সমীকরণে ভরা একটি খাতা, যা পরবর্তীতে “লস্ট নোটবুক” নামে খ্যাত হয়ে ওঠে।

এই লস্ট নোটবুকের বিষয়বস্তু প্রথমে ছিল অজানা। ১৯৭৬ সালে গণিতবিদ জর্জ অ্যান্ড্রুজ যখন ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে বসে রামানুজনের সংরক্ষিত নথিপত্র ঘাঁটছিলেন, তখন নতুনভাবে আবিষ্কৃত হয় এই অমূল্য খাতা। এতে ছিল এমন সব অঙ্কের সূত্র, যেগুলোর ভাষা ছিল জটিল অথচ সৌন্দর্যময়, কিন্তু এর অর্থ তখনও ছিল বিজ্ঞানের কাছে অধরা।

এই খাতায় রামানুজন বর্ণনা করেন এমন এক গাণিতিক ফাংশনের কথা, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন “মক থেটা ফাংশন”। আধুনিক গণিতে এদের বলা হয় “মক মডুলার ফর্ম”। এই ফাংশনের তাত্ত্বিক ভিত্তি সেই সময়ে গড়ে ওঠেনি, ফলে রামানুজনের এই লেখাগুলোর ব্যাখ্যা তখনকার দিনে কোনো গণিতজ্ঞই স্পষ্টভাবে দিতে পারেননি।

২০০২ সালে ডন জাগার, সান্ডার রাজন, কেন ওনো ও ক্যাথরিন ব্রিংম্যান প্রমুখ গণিতবিদ মিলে এই মক মডুলার ফর্মের গাণিতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরা দেখান, এই ফর্মগুলো আসলে “হারমোনিক মাস ফর্ম”-এর অংশ, যার অনেক বৈশিষ্ট্য মডুলার ফর্মের মতো হলেও এতে আছে কিছু অতিরিক্ত জটিলতা।

এরপর আসে এক বিস্ময়কর সংযোগ। স্ট্রিং থিওরি এবং ব্ল্যাকহোল এনট্রপির মতো আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা যায়, কিছু সুপারসিমেট্রিক ব্ল্যাকহোলের "মাইক্রোস্টেট" গণনার সময় যে পার্টিশন ফাংশন ব্যবহৃত হয়, তা অনেকাংশেই রামানুজনের সেই মক মডুলার ফর্মের সঙ্গে মিলে যায়। বিশেষ করে, অতীশ দাভোলকর এবং সামীর মুর্তির গবেষণায় দেখা যায়, “এন = ৪ সুপারসিমেট্রিক ব্ল্যাকহোল” সম্পর্কিত সমস্যায় রামানুজনের সূত্রগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ভাবতেই অবাক লাগে, এক শতাব্দী আগে দক্ষিণ ভারতের এক স্বশিক্ষিত গণিত সাধকের খাতায় লিখে রাখা ফর্মুলা গুলো আজ ব্যবহার করা হচ্ছে মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় ব্ল্যাকহোলের রহস্যের জট খুলতে। 

রামানুজনের সেই "লস্ট নোটবুক" আর "মক মডুলার ফর্ম"-এর গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, গণিত শুধুমাত্র সংখ্যার মারপ্যাঁচ নয়, বরং এমন একটি সূক্ষ্ম ভাষা, যার প্রতিটি ছন্দে জড়িয়ে আছে মহাবিশ্বের গভীরতম সত্যের ইঙ্গিত।

Comments