আদিম ডিএনএর সন্ধানে


বর্তমান পৃথিবীতে আমরাই মানুষের একমাত্র প্রজাতি। বিজ্ঞানের ভাষায় আমাদের নাম, হোমো স্যাপিয়েন্স। কিন্তু মানুষের প্রাচীন ইতিহাস বলে, এক সময় পৃথিবীতে হোমো সেপিয়েন্স ছাড়াও অন্য প্রজাতির মানুষ বসবাস করত। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো নিয়ানডারথাল মানুষ। এদের বৈজ্ঞানিক নাম, হোমো নিয়ানডারথালেনসিস। এরা প্রায় চার লক্ষ বছর আগে ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়। নিয়ানডারথাল মানুষেরা পৃথিবী থেকে কেন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল তা নিয়ে অবশ্য নানা মুনির নানা মত রয়েছে। 

এতদিন ধারণা করা হতো, নিয়ানডারথাল এবং বর্তমানের আধুনিক মানুষ এ দুই মানব  প্রজাতির মাঝে কোন সম্পর্ক বা কোন মিল নেই। কিন্তু এই ধারণায় ফাটল ধরালেন একজন সুইডিশ বিজ্ঞানী। তাঁর নাম, স্বান্তে প্যাবো। তিনি হাজার বছরের পুরোনো জীবাশ্ম থেকে নিয়ানডারথাল ডিএনএ বের করে প্রমাণ করলেন, ওদের সাথে আমাদের ডিএনএর কিছুটা হলেও সাদৃশ্য রয়েছে।

শুনতে সহজ মনে হলেও, বাস্তবে এটি ছিল প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। যে কোন মৃতদেহের ডিএনএ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে যায়, ক্ষয় হয়ে যায় অথবা সংক্রামিত হয়। এমনকি গবেষকের নিজের ডিএনএও এতে মিশে যেতে পারে। সুতরাং হাজার হাজার বছরের পুরোনো জীবাশ্ম থেকে নিয়ানডারথালদের পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ সংগ্রহ করাটা ছিল অত্যন্ত দুরূহ এবং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু তারপরও প্যাবো এবং তাঁর সহযোগীরা অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত ল্যাবে ডিএনএ এক্সট্র্যাকশন, পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (PCR) এবং বায়ো ইনফরমেটিক্স ব্যবহার করে ধীরে ধীরে সেই আদিম ডিএনএ থেকে তুলে আনলেন নিয়ানডারথালদের প্রাচীন ইতিহাস।

২০০৬ সালে জার্মানির একটি গুহা থেকে পাওয়া নিয়ানডারথালদের   হাড়ের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে, ২০১০ সালে তাঁরা প্রকাশ করলেন এই বিলুপ্ত মানব প্রজাতির পুরো জিনোম সিকোয়েন্স। আর তখনই জানা গেল এক বিস্ময়কর সত্য।

আজকের ইউরোপ, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার মানুষদের জিনোমে প্রায় ১.৫ থেকে ২.১ শতাংশ নিয়ানডারথালদের ডিএনএর ছাপ রয়েছে। এর সহজ অর্থ হলো, আদিম মানুষের সাথে নিয়ানডারথালদের ইন্টারব্রিডিং ঘটেছিল। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষেরা যখন আফ্রিকা ছেড়ে ইউরেশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে তখন নিয়ানডারথালদের সাথে তাদের জিনের সংমিশ্রণ ঘটেছিল। অন্যদিকে আফ্রিকার মানুষের মধ্যে নিয়ানডারথালদের জিনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। 

এই আবিষ্কারটি ছিল এক কথায় অসাধারণ। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন, আধুনিক মানুষের বিবর্তন কোন সরলরৈখিক ধারায় ঘটেনি। প্রাচীন যুগে বিভিন্ন মানব প্রজাতির মধ্যে জিনগত সংমিশ্রণ ঘটেছিল। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, আমরা এখনো নিয়ানডারথালদের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য বহন করে চলেছি।  আমাদের ত্বকের রং, চুলের গঠন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, এমনকি টাইপ টু ডায়াবেটিস বা অ্যালার্জির প্রবণতা পর্যন্ত নিয়ানডারথাল জিনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত।

প্রাচীন ডিএনএ নিয়ে প্যাবো আরো কিছু গবেষণা করেছেন। ২০০৮ সালে সাইবেরিয়ার একটি গুহায় পাওয়া যায় আরেকটি বিলুপ্ত মানব প্রজাতির একটি আঙ্গুলের হাড়। এই প্রজাতির নাম ডেনিসোভান। এই হাড় থেকে ডিএনএ নিয়ে বিশ্লেষণ করে তিনি দেখালেন, তিব্বতের শেরপা জনগোষ্ঠী আর ওশেনিয়ার কিছু আদিবাসীদের মধ্যেও ডেনিসোভানদের জিন এখনো রয়ে গেছে। এমনকি EPAS1 নামের এক বিশেষ জিন, যা পাহাড়ি উচ্চতায় অক্সিজেনের অভাব সহ্য করতে মানুষকে সহায়তা করে, সেটিও এই ডেনিসোভান উৎস থেকেই এসেছে।

২০২২ সালে, আদিম ডিএনএ নিয়ে যুগান্তকারী গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে, স্বান্তে প্যাবো চিকিৎসাবিজ্ঞান বা শারীরতত্ত্বে নোবেল পুরস্কারে পান। শুধু এই পুরস্কার প্রাপ্তিই নয়, তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন জীববিজ্ঞানের এক নতুন গবেষণাক্ষেত্র, যার নাম প্যালিওজিনোমিক্স। স্বান্তে প্যাবো এখনো নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন এক দুঃসাহসিক বৈজ্ঞানিক অভিযাত্রায় যার মধ্য দিয়ে, অতীত আর বর্তমানের মানুষের মাঝে জিনগত সেতুবন্ধন তৈরি হচ্ছে।

Comments