হারম্যান মিনকোভস্কি: চতুর্মাত্রিক বাস্তবতার স্থপতি


বিজ্ঞানের ইতিহাস রোমাঞ্চকর এক যাত্রাপথ।  যেখানে প্রতিটি যুগ তার নিজস্ব ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এক সময় মানুষ ভাবত পৃথিবী সমতল, পরে জানা গেল সেটা গোল। মানুষ ভাবত সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। পরে জানল ঠিক তার উল্টো। আবার মানুষ বহু শতাব্দী ধরে ভেবেছে - আমাদের চারপাশের বাস্তবতা দাঁড়িয়ে আছে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা এই তিনটি স্হানিক মাত্রার ওপর। এই তিনটি মাত্রাই আমাদের অস্তিত্বের সামগ্রিক গণ্ডি। কিন্তু এই ধারনা পাল্টে গেল একদল গণিতবিদ, সাহিত্যিক এবং পদার্থবিজ্ঞানীর কল্পনা ও যুক্তির আশ্চর্য সম্মিলনে। আর সেই বিপ্লবের মূলে ছিল একটি যুগান্তকারী ভাবনা - স্থানের মত সময়ও একটি মাত্রা। স্হান আর সময় একসাথে মিলে গড়ে তুলেছে স্পেসটাইম বা স্হান-কাল, চতুর্মাত্রিক এক বাস্তবতা।

এই চতুর্থ মাত্রার ধারণা কোনো একদিন হঠাৎ করে উদিত হয়নি। এর সূচনা হয় উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি, যখন গণিতবিদরা ইউক্লিডীয় জ্যামিতির বাইরে চিন্তা করতে শুরু করেন। তারা ভাবলেন, যদি একটি সরল রেখার বহু কপি মিলে একটি তল তৈরি করে, আর তলের বহু কপি মিলে একটি ঘনবস্তু হয়, তাহলে ঘনবস্তুর বহু কপি কি কোনো অদৃশ্য, উচ্চতর মাত্রার বস্তুর জন্ম দিতে পারে না? এই ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় হাইপারস্পেস বা অতিরিক্ত মাত্রার ধারণা। তখনও তা নিছক কল্পনা, কিন্তু একদম অযৌক্তিক নয়।

১৮৮৪ সালে এই ধারণাকে নিয়ে সাহিত্যের জগতে আসেন এডউইন অ্যাবট। তাঁর বই ফ্ল্যাটল্যান্ডে তিনি গল্প বলেন এক দ্বিমাত্রিক জগতের প্রাণীদের নিয়ে, যাদের জগতে হঠাৎ করেই আসে একটি ত্রিমাত্রিক গোলক। সেই গোলক বলে, তোমাদের জগত ছাড়াও এক উচ্চতর বাস্তবতা আছে, যেটা তোমরা কল্পনাও করতে পারো না। এই গল্প সবার মনে প্রশ্ন জাগায়,‌ তাহলে আমরাও কি এমন কোনও উচ্চতর মাত্রার বেড়াজালে বন্দি, যার অস্তিত্ব আছে, অথচ চোখে দেখা যায় না?

এই কল্পনার মেঘ থেকে নেমে এলেন হারম্যান মিনকোভস্কি।
তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান জার্মান গণিতজ্ঞ। তিনি গণিতের ভাষায় বললেন, যদি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সত্যি হয়, তবে সময় আর স্থানকে আলাদা করে ভাবা যাবে না। তারা একসঙ্গে মিলে তৈরি করে স্পেসটাইম—একটি চতুর্মাত্রিক ক্ষেত্র।  যেখানে প্রতিটি ঘটনার একটি সময়গত অবস্থান এবং স্থানগত অবস্থান রয়েছে। এই অবস্থানকে তিনি বললেন ইভেন্ট, আর কোনো বস্তুর চলাচল এই স্পেসটাইমে যে রেখা তৈরি করে, তা হলো, ওয়ার্ল্ডলাইন।

এই ভাবনাটি শুধু গণিতের খেলাই নয়, এটি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি। কারণ স্পেসটাইমের এই কাঠামো থেকেই আমরা বুঝতে পারি সময় কিভাবে ধীর হয়, কিভাবে বস্তুর গতি সময়ের প্রবাহকে কমিয়ে দেয়, কিভাবে বস্তুর ভর স্পেসটাইমকে বাঁকিয়ে দেয় আর সেটাই আমরা টের পাই “মহাকর্ষ বল” হিসেবে। ভারী বস্তু আসলে কোন কিছুকে টানে না। বস্তুর ভর স্পেসটাইমকে শুধুমাত্র বাঁকিয়ে দেয়, আর সেই বাঁকে পড়ে অন্য বস্তু তার নিজের চলার পথ পাল্টায়।

চতুর্মাত্রিক জগতের ধারণা সবচেয়ে সহজভাবে বোঝা যায় একটি কাল্পনিক গঠন দিয়ে, যার নাম আলোক-শঙ্কু (light cone) । ধরুন, আপনি এখন একটি নির্দিষ্ট জায়গায়, একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে অবস্থান করছেন। এখান থেকে আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, এবং যত দূরে তা পৌঁছায়, তত সময় অতিক্রান্ত হয়। এই আলো ভবিষ্যতে যেসব জায়গায় পৌঁছাতে পারবে, সেই অঞ্চলকে বলা হয় ভবিষ্যতের আলোক-শঙ্কু।
একইভাবে, আপনি এখন যে ঘটনাগুলো দেখছেন, যেমন সূর্যের আলো, যেটি আট মিনিট বিশ সেকেন্ড আগে সূর্য থেকে রওনা হয়ে পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে। তার মানে সূর্যের আলো আট মিনিট বিশ সেকেন্ড অতীত থেকে এসেছে। অতীতের যেসব ঘটনা থেকে আলো এসে আপনার বর্তমান মুহূর্তে পৌঁছেছে, সেই অঞ্চলই গঠন করে অতীতের আলোক-শঙ্কু।  অতীত ও ভবিষ্যতের এই দুটি শঙ্কুর মিলন বিন্দুতেই আপনার বর্তমান অবস্থান। এই দুটি শঙ্কুর গঠনের মাধ্যমে বোঝা যায়, আপনি কোন ঘটনার প্রভাব পেতে পারেন এবং কোন ঘটনা আপনার কাছে কখনও পৌঁছাতে পারবে না। অর্থাৎ, সময় ও স্থানের এই মিলিত কাঠামো আমাদের অস্তিত্বকে বেঁধে রেখেছে একটি নিখুঁত প্রাকৃতিক নিয়মে। যেখানে প্রতিটি কারণের একটি নির্দিষ্ট ফলাফলের সীমা আছে। এই সীমার বাইরে কিছু ঘটার অর্থ হচ্ছে সময়ের স্বাভাবিক ধারাকেই অস্বীকার করা। আর সেই কারণেই, চতুর্মাত্রিক জগৎ কেবল একটি ধারণা নয়, বরং বাস্তবতার এক কঠিন এবং নিয়মবদ্ধ রূপ।

হারম্যান মিনকোভস্কির এই “স্পেসটাইম” ধারণা আলবার্ট আইনস্টাইনকে সাহায্য করেছিল এক মহা তত্ত্ব গঠনে। তিনি এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে তোলেন তাঁর বিখ্যাত জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি বা সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। এর ফলে ব্ল্যাকহোল, গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং, মহাবিশ্বের প্রসারণ, সময়ের বাঁক এবং এমনকি সময়ভ্রমণ—এই সব কিছুই কেবল গল্প নয়, বরং বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার অন্তর্গত হয়ে পড়ে।

কিন্তু এতদূর এলেও বিজ্ঞান থেমে থাকেনি। চতুর্মাত্রার বাইরে এখন পদার্থবিদরা ভাবছেন ১০টি অথবা ১১টি মাত্রার কথা। স্ট্রিং থিওরি নামের এক তত্ত্ব বলছে, এই মহাবিশ্বের গভীরতর গঠন এমনই সূক্ষ্ম যে, অধিকাংশ মাত্রাগুলো আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। সেগুলো ভাঁজ হয়ে আছে স্থান-কালের অতি ক্ষুদ্র স্কেলে। আর এই বহু-মাত্রার মধ্যে কোথাও হয়তো রয়েছে "ওয়ার্মহোল", দুই ভিন্ন স্পেসটাইম অঞ্চলকে জোড়া দেওয়া সেতু, যার ভেতর দিয়ে সময়ভ্রমণ বা আন্তঃগ্যালাকটিক ভ্রমণ একদিন বাস্তব হতে পারে।

চতুর্মাত্রিক জগত চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তার অস্তিত্ব রয়েছে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে। যখন ঘড়ির কাঁটা এগোয়, যখন কোনো বস্তুর গতি বাড়লে তার ঘড়ি ধীরে চলে, যখন কোন তারা অদৃশ্য হয়ে যায় ব্ল্যাকহোলে, তখন আমরা বুঝতে পারি— তিন মাত্রিক শরীর নিয়ে বেঁচে থাকলেও, আমাদের অস্তিত্ব মূলত একটি চতুর্মাত্রিক নাট্যশালার চরিত্র।

এই চতুর্মাত্রা তাই কেবল একটি বৈজ্ঞানিক মডেল নয়। এটি আমাদের সময়-চেতনার মানচিত্র, স্থান-অনুভূতির গভীরতা, আর আমাদের ভবিষ্যতের সম্ভাবনার পটভূমি। যারা বলে সময় বয়ে যায়, তারা ভুল বলেন। আসলে আমরাই বয়ে যাই সময়ের মধ্যে দিয়ে। একটি অদৃশ্য, বাঁকানো, জীবন্ত স্পেসটাইমের নদী বেয়ে আমাদের অস্তিত্ব প্রতিটি মুহূর্তে সাঁতরে চলেছে।

মাত্র ৪৪ বছর বয়সে হারম্যান মিনকোভস্কির অকাল মৃত্যু হলেও,  তাঁর চিন্তা চিরজীবী। তাঁর চতুর্মাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি আজও আমাদের মহাবিশ্বকে বোঝার চাবিকাঠি হয়ে রয়েছে। তিনি সময়কে ক্যালেন্ডার অথবা ঘড়ির কাঁটা থেকে উদ্ধার করে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন বাস্তবতার কেন্দ্রবিন্দুতে। আর এরকম সৃষ্টিশীল মানসিক বিপ্লবই আমাদের শেখায়, সবচেয়ে বড় সত্যগুলো চোখে দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায় কল্পনা, যুক্তি আর চিন্তার সম্মিলিত আলোকছটায়। 

© তানভীর হোসেন

Comments