বাংলাদেশের গর্ব: প্রফেসর এম. জাহিদ হাসান

অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণাদের জগত চলে  কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়মে। এই জগতের নিয়ম-কানুন আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার থেকে একদমই আলাদা। এক কথায় বলা যায়, কোয়ান্টাম জগতের নিয়ম-কানুন গুলো বড়ই রহস্যময়। কিন্তু কিছু কিছু বিজ্ঞানী আছেন, যারা এই রহস্যময় জগতে ডুব দিয়ে এমন সব আবিষ্কার করছেন, যা কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে প্রযুক্তির জন্য ব্যবহারযোগ্য করে তুলছে। ‌এদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন, প্রফেসর এম. জাহিদ হাসান।  বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের ইউজিন হিগিনস অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন।

প্রফেসর জাহিদ হাসানের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে বাংলাদেশে। ছোটবেলা থেকেই তাঁর কৌতূহল ছিল আকাশ ছোঁয়া। মহাবিশ্বের সবকিছু কীভাবে কাজ করে, মহাবিশ্বের গোপন রহস্য কী—এসব জানার এক অদ্ভুত নেশা ছিল তাঁর। সেই আগ্রহই তাঁকে নিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট করার পর তিনি হার্ভার্ডে গবেষণা করেন। তারপর যোগ দেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি শুধু ধরাবাঁধা একজন গবেষক নন। তিনি এমন এক বিজ্ঞানী, যিনি পদার্থবিজ্ঞানের রহস্যগুলোকে আলোর সামনে নিয়ে আসছেন এবং এর মাধ্যমে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে তুলছেন।

২০১৫ সালে তিনি এবং তাঁর গবেষক দল আবিষ্কার করেন ভাইল ফার্মিয়ন, বিশেষ এক ধরনের কণা। এই কণা ৮৫ বছর ধরে বিজ্ঞানীদের চোখের আড়ালে ছিল। ১৯২৯ সালে জার্মান বিজ্ঞানী হারমান ভাইল এই কণার ধারণা তাত্ত্বিকভাবে দিয়েছিলেন। কিন্তু এত বছরেও কেউ একে খুঁজে পাননি। ভাইল ফার্মিয়ন মূলত ভরশূন্য ইলেকট্রন। ‌ বিজ্ঞানীদের ধারণা, মহাবিশ্বের আদিম অবস্থায় এই কণার অস্তিত্ব ছিল। এই কণার বিশেষত্ব হলো এটি বাঁধাহীন ভাবে চলতে পারে, একেবারে অবিরাম গতিতে। সহজ ভাষায় বললে, এর মানে হলো এর ব্যবহার করা গেলে ভবিষ্যতের কম্পিউটার, স্মার্টফোন ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস আরও দ্রুত ও শক্তিশালী হতে পারবে। শুধু তাই নয়, ভাইল ফার্মিয়ন আদি মহাবিশ্ব সম্বন্ধে মানুষের জ্ঞানকে আরো সমৃদ্ধ করবে। 

এরপর ২০১৮ সালে, তিনি আরেকটি অবিশ্বাস্য গবেষণার নেতৃত্ব দেন, টপোলজিক্যাল ক্যাগোমে কোয়ান্টাম ম্যাগনেট আবিষ্কার করে। এটি এমন এক পদার্থ, যা চুম্বকীয় শক্তিকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে ব্যবহার করতে পারে। এই আবিষ্কার কম্পিউটারের হার্ডড্রাইভ বা মেমোরির ধারণক্ষমতা শতগুণ বাড়াতে পারে। ভবিষ্যতের তথ্য সংরক্ষণ ও ট্রান্সমিশনে এটি এক নতুন যুগের সূচনা করবে। শুধু তথ্য প্রযুক্তি নয়, চিকিৎসা বিজ্ঞানেও এটি বিপ্লব আনতে পারে।

এইসব অসাধারণ গবেষণাগুলোর জন্য তিনি বিশ্বের অন্যতম সম্মানজনক পুরস্কার, আর্নেস্ট অরল্যান্ডো লরেন্স পুরস্কার পান ২০২০ সালে। এটি এমন এক স্বীকৃতি, যেটা শুধুমাত্র সেসব বিজ্ঞানীদের দেওয়া হয়, যাঁরা বিজ্ঞানের মাধ্যমে প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও বিশ্বকে বদলে দিচ্ছেন।

প্রফেসর এম. জাহিদ হাসানের বর্তমান গবেষণার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, টপোলজিক্যাল ইনসুলেটর নিয়ে তাঁর কাজ, বিশেষ করে সাধারণ তাপমাত্রায় এদের কার্যকারিতা। টপোলজিক্যাল ইনসুলেটর এমন এক ধরনের পদার্থ, যার ভেতরটা বিদ্যুৎ অপরিবাহী কিন্তু পৃষ্ঠতল বিদ্যুৎ পরিবাহী। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, টপোলজিক্যাল ইনসুলেটরের পৃষ্ঠতল সুপার কন্ডাক্টরের মতোই শক্তি অপচয় না করেই বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারে। এই বৈশিষ্ট্য কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং স্পিনট্রনিক্সের মতো উন্নত প্রযুক্তির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রচলিত টপোলজিক্যাল ইনসুলেটর সাধারণত অত্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রায় কার্যকর হয়। এটা তাদের ব্যবহারিক প্রয়োগে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। তবে, প্রফেসর হাসান ও তাঁর গবেষণা দল এমন টপোলজিক্যাল ইনসুলেটর আবিষ্কারের প্রচেষ্টায় রয়েছেন, যা সাধারণ তাপমাত্রায়ও কার্যকর থাকতে পারে। এই ধরনের পদার্থ আবিষ্কৃত হলে, সেটা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং অন্যান্য উচ্চপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হবে।

প্রফেসর হাসান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, এমন এক পদার্থের উদাহরণ হলো বিসমাথ ব্রোমাইড (Bi₄Br₄) যা সাধারণ তাপমাত্রায় টপোলজিক্যাল ইনসুলেটরের বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করতে সক্ষম। এই ধরনের পদার্থের গবেষণা ভবিষ্যতে উচ্চ তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাকটিভিটি এবং অন্যান্য কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য নিয়ে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। প্রফেসর হাসানের গবেষণা কোয়ান্টাম প্রযুক্তির উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে, যা ভবিষ্যতে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে।

আমরা সাধারণত বাংলাদেশী বিজ্ঞানীদের কথা কমই শুনি। কিন্তু যখন একজন বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর গবেষণা সারা পৃথিবীর জন্য নতুন প্রযুক্তির সম্ভাবনা দেখাচ্ছে, তখন তো সেটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। আশা করি, তাঁর গবেষণা হয়তো আর কয়েক দশকের মধ্যেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠবে। 

প্রফেসর জাহিদ হাসানের গবেষণা সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য জানতে হলে 
এখানে ক্লিক করুন 

https://zahidhasangroup.scholar.princeton.edu/home


Comments