কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট ও সময়ের রহস্য

মনে করুন, আপনার দুই বন্ধুর  একজন আছে পৃথিবীর এক প্রান্তে, আর অন্যজন রয়েছে আরেক প্রান্তে। হঠাৎ এক বন্ধুর মনে একটি বিশেষ চিন্তার উদয় হতেই, অন্য বন্ধুর মনে ঠিক একই চিন্তা এলো। তাও কোনো ফোন কল, মেসেজ বা ইন্টারনেট ছাড়াই! কেমন হবে ব্যাপারটা? অলৌকিক, তাই না?
 
আশ্চর্য ব্যাপার হলো, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণাদের কোয়ান্টাম জগতেও এমনই এক ঘটনা ঘটে, যাকে বলা হয়, এন্টেঙ্গেলমেন্ট। সোজা বাংলায় এর মানে হলো পরস্পর জড়িয়ে হয়ে থাকা‌ বা বিজড়ন।  বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, প্রকৃতিতে দুটো বস্তুকণার উদ্ভব এমনভাবে হতে পারে, যেখানে একটি বস্তুকণার কোয়ান্টাম চরিত্র ব্যাখা করলে অন্য বস্তুকণাটির কোয়ান্টাম চরিত্রও জানা যায়। যদিও আপাতদৃষ্টিতে দুটি বস্তুকণার মধ্যে সরাসরি কোন যোগাযোগ নেই।  কিন্তু কোন এক অদৃশ্য বন্ধনে কোয়ান্টাম জগতের একটি বস্তুকণা অন্য একটি দূরবর্তী বস্তুকণার সাথে সরাসরি জড়িত থাকতে পারে। পদার্থবিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয়,  কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট। বাংলায় কোয়ান্টাম বিজড়ন বলা যেতে পারে।

কোয়ান্টাম জগতের অদ্ভুত এই নিয়মে দুই বস্তুকণা একবার পরস্পরের সাথে জড়িয়ে পড়লে, তারা চিরকাল একে অপরের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারে। আলবার্ট আইনস্টাইন একে বলেছিলেন, spooky action at a distance; এ যেন দূর থেকে কোন ভৌতিক সংযোগ। বলাই বাহুল্য, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই এন্টেঙ্গেলমেন্ট  বিষয়টি নিয়ে আইনস্টাইন বেশ অস্বস্তিতে ছিলেন। 

ষাটের দশকে, জন স্টুয়ার্ট বেল নামে একজন পদার্থবিজ্ঞানী কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট নিয়ে আইনস্টাইনের অস্বস্তির উত্তর দিয়েছিলেন। তিনি জড়িয়ে থাকা দুটি দূরবর্তী পদার্থকণার মাঝে অসমতার তত্ত্ব নিয়ে "বেল থিওরেম" প্রকাশ করেছিলেন‌। বেল অসমতার লঙ্ঘনই হলো, কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্টের প্রমাণ। 

সত্তুরের দশকে জন ক্লাউসার, আশির দশকে অ্যালান আসপেক্ট এবং নব্বইয়ের দশকে অ্যান্টন জেলিঙ্গার পৃথক পৃথক পরীক্ষার মাধ্যমে বেল অসমতার লঙ্ঘন প্রমাণ করেছিলেন। তাঁদের যুগান্তকারী পরীক্ষার মধ্য দিয়েই পদার্থবিজ্ঞানে কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্টের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এজন্য ২০২২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে তাঁদের তিনজনকেই নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে— সময় এখানে কী ভূমিকা রাখে? কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট কি আমাদের প্রচলিত সময়ের ধারণাকে বদলে দিতে পারে? নাকি সময় এখানে একেবারেই গৌণ? চলুন, এই রহস্যের খোঁজ নেওয়া যাক।‌

দুটো সাধারণ বস্তুর মধ্যে সম্পর্ক তখনই বোঝা যায়, যখন একটি অন্যটির উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। কিন্তু কোয়ান্টাম জগতের হালচাল সম্পূর্ণ আলাদা। ধরা যাক, দুটি ইলেকট্রন কোন সময় একসাথে ছিল। যদি কোনোভাবে তাদের আলাদা করে ফেলা হয়, এমনকি একটিকে পৃথিবীতে রেখে অন্যটিকে মঙ্গল গ্রহেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তাহলেও একটির অবস্থান বা স্পিন পরিবর্তন করলে অন্যটির মধ্যেও সাথে সাথে সেই পরিবর্তন ঘটবে।

কিন্তু কীভাবে এটা সম্ভব? সাধারণ যুক্তিতে বলে, তথ্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছাতে সময় নেয়। কিন্তু কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট ফলে এই পরিবর্তন হয় তাৎক্ষণিক। এর মানে কি আলোর গতির চেয়েও দ্রুত কিছু  এখানে কাজ করছে? নাকি দুই বস্তুকণাই সময়ের বাইরে কোনো এক অদৃশ্য সংযোগে আবদ্ধ?

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সময় সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। সময়ের পটভূমিতেই সকল ঘটনা ঘটে। সময়ের স্রোতে ভেসে অতীত থেকে বর্তমানের ভেতর দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে আমরা এগিয়ে যাই। কিন্তু কোয়ান্টাম জগতে সময়ের অস্তিত্ব যেন ধোঁয়াশার মতো। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, কখনও কখনও একটি কণা এমনভাবে আচরণ করে, যেন এটি ভবিষ্যতের ঘটনাকে প্রভাবিত করতে পারে। এমনকি যদি সেটি অতীতেই ঘটে থাকে! এটি অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু আধুনিক কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পরীক্ষাগুলো এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে।

কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট বলে দেয়, আমাদের নিত্যদিনের সময়ের সরল রৈখিক ধারণা ভুল হতে পারে। হয়তো বাস্তবতা এমন এক সমীকরণে গাঁথা, যেখানে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই একসাথে বিদ্যমান। আর বিজড়িত কণাগুলো সেই সময়হীন সংযোগের মাধ্যমে একসাথে কাজ করে। 

এন্টেঙ্গেলমেন্টের এই রহস্য শুধু তাত্ত্বিক ধারণা নয়। একে ব্যবহার করে ভবিষ্যতে এমন সব তথ্য প্রযুক্তি তৈরি হতে চলেছে যা সম্পূর্ণরূপে বদলে দেবে আমাদের তথ্য আদান-প্রদান এবং কম্পিউটিং পদ্ধতি। কোয়ান্টাম কম্পিউটার ইতিমধ্যেই পরীক্ষাধীন, যা আজকের সুপার কম্পিউটারের তুলনায় লক্ষগুণ দ্রুত কাজ করতে সক্ষম। নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম এনক্রিপশন পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছেন, যা হ্যাক করা একেবারেই অসম্ভব।

আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন— যদি আমরা সত্যিই কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্টের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারি, তাহলে কি সময়ের মাঝে পরিভ্রমণ করা সম্ভব? বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন, তবে কিছু কিছু গবেষণা এই প্রশ্নের দিকেই ইঙ্গিত করছে।

কোয়ান্টাম জগতের এই বিস্ময় আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বাস্তবতা কেবলমাত্র দৃশ্যমান পারিপার্শ্বিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রকৃতির গভীরে এমন কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে, যা আমাদের প্রচলিত বিজ্ঞানের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। সময় কি সত্যিই একটা প্রবাহ, নাকি শুধু আমাদের মনের তৈরি একটা বিভ্রম? কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট আমাদেরকে এমনই এক নতুন বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়।  হয়তো কোনো এক দিন, আমরা এর উত্তর খুঁজে পাবো।

© তানভীর হোসেন

Comments