আমরা যখন রাতের বেলা আকাশের দিকে তাকাই, অসংখ্য গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা আর গ্যালাক্সি দেখতে পাই। এক চিলতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমরা ভাবি, এই বিশাল মহাবিশ্ব হয়তো ঠিক এরকম - নক্ষত্রে ভরা, আলোয় উদ্ভাসিত, বিশাল বিস্তৃতির এক রহস্যময় জগৎ। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, আমরা যা দেখি, তা আসলে মহাবিশ্বের খুবই ক্ষুদ্র একটি অংশ। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা বলে, এই দৃশ্যমান মহাবিশ্ব, যেখানে গ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সি আছে, তা মোট মহাবিশ্বের মাত্র ৫ শতাংশ! তাহলে বাকি ৯৫ শতাংশ গেল কোথায়?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাদের মহাবিশ্বের বাকি অংশ অদৃশ্য, কারণ সেটা সরাসরি আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। এই ৯৫ শতাংশের মধ্যে ২৭ শতাংশ হলো, ডার্ক ম্যাটার, আর ৬৮ শতাংশ হলো, ডার্ক এনার্জি।
ডার্ক ম্যাটার এমন এক রহস্যময় পদার্থ, যা আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু যার মহাকর্ষীয় প্রভাব আমরা টের পাই। ডার্ক ম্যাটার গ্যালাক্সিগুলোকে একত্রে ধরে রাখে, মহাবিশ্বের কাঠামো তৈরি করে। অন্যদিকে, ডার্ক এনার্জি এক রহস্যময় শক্তি, যা মহাবিশ্বের প্রসারণকে বাড়িয়ে তুলছে, একে ক্রমাগত প্রসারিত করে চলেছে।
আমরা এখনো জানি না, এই ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জি আসলে কী দিয়ে তৈরি। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার—আমাদের চেনাজানা মহাবিশ্বের বাইরেও এক অদৃশ্য বাস্তবতা রয়েছে, যা আমাদের ইন্দ্রিয়ের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। মহাবিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রহস্যের চাবিকাঠি ধারণ করে আছে এই ৯৫ % অদৃশ্য পদার্থ ও শক্তি। এই অদৃশ্য জগতকে বুঝতে পারলে হয়তো আমরা বুঝতে পারব, মহাবিশ্বের প্রকৃত স্বরূপ আসলে কী।
ডার্ক ম্যাটারকে দেখা যায় না, কারণ এ থেকে কোন আলো প্রতিফলিত হয় না। কিন্তু এর অস্তিত্ব নিয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত। কারণ গ্যালাক্সিগুলোর গতিপ্রকৃতি, মহাবিশ্বের প্রসারণ, এবং মহাকর্ষীয় বলের ব্যাখ্যায় ডার্ক ম্যাটার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৩৩ সালে সুইস জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রিটজ জ্বিকি কোমা ক্লাস্টার গ্যালাক্সির সব নক্ষত্রের ভর বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারলেন, দৃশ্যমান নক্ষত্রগুলো দিয়ে ঐ গ্যালাক্সিপুঞ্জের প্রবল মহাকর্ষ বলের কোনো যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। তাঁর কাছে মনে হলো, ওই গ্যালাক্সিগুলোর ভেতরে আরো অনেক পদার্থ নিখোঁজ অবস্থায় রয়েছে। সাধারণ হিসাবে, এই গ্যালাক্সিগুলো ছিটকে পড়ার কথা ছিল, কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। তাহলে কি মহাবিশ্বে এমন অদৃশ্য কিছু আছে যা আমরা দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু যেটা মহাকর্ষ সৃষ্টি করে? এখান থেকেই শুরু হয় ডার্ক ম্যাটার নিয়ে অনুসন্ধান।
এরপর ১৯৭০-এর দশকে মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভেরা রুবিন গ্যালাক্সিগুলোর ঘূর্ণনের বিশ্লেষণ করে দেখালেন যে, দৃশ্যমান পদার্থের চেয়েও অনেক বেশি কিছু মহাবিশ্বে আছে, যা আমাদের চোখে পড়ে না, কিন্তু বিশাল মহাকর্ষ সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানীরা তখন নিশ্চিত বুঝতে পারলেন, মহাবিশ্বের বেশিরভাগ পদার্থই আমাদের অজানা।
কিন্তু ডার্ক ম্যাটার কী দিয়ে তৈরি? অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, এটি কোনো সাধারণ কণা নয়, বরং উইম্পস (WIMP -Weakly Interacting Massive Particles) বা এক্সোটিক কণা দিয়ে তৈরি, যা এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেকে আবার নিউট্রিনোর মতো অতিক্ষুদ্র ও প্রায় ভরহীন কণার সম্ভাবনার দিকেও নজর দিয়েছেন। যুগের পর যুগ গবেষণা করেও বিজ্ঞানীরা এখনো ডার্ক ম্যাটারকে সরাসরি শনাক্ত করতে পারেননি। কিন্তু মহাবিশ্ব জুড়ে এর প্রবল প্রভাব দেখা যায়, বিশেষ করে যখন মহাকাশের বিশাল গ্যালাক্সি ক্লাস্টারগুলোর মধ্য দিয়ে আলো প্রবাহিত হয়। তখন এই আলো বাঁকা হয়ে যায়, যাকে বলে, গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং, এটা ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বের অন্যতম শক্তিশালী প্রমাণ।
বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বিভিন্ন ভূগর্ভস্থ ল্যাবরেটরিতে, মহাকাশে পাঠানো উপগ্রহের মাধ্যমে, এমনকি লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের মতো বিশাল পার্টিকেল এক্সেলেটর ব্যবহার করে ডার্ক ম্যাটারের কণার সন্ধান করছেন।
ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান প্রতিনিয়ত নতুন গবেষণার মাধ্যমে সমৃদ্ধ হচ্ছে। সম্প্রতি, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটি রহস্যময় ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, যা ডার্ক ম্যাটারের নতুন ধরনের অস্তিত্বের ইঙ্গিত দিতে পারে। বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন, আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থলে বিশাল পরিমাণে ধনাত্মক চার্জযুক্ত হাইড্রোজেন গ্যাস রয়েছে।যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ লন্ডনের গবেষক বিজ্ঞানী শ্যাম বালাজি বলেছেন, এই গ্যাসের আয়নায়নের পেছনে সম্ভাব্য কারণ হিসেবে হালকা ভরের ডার্ক ম্যাটার কণার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে, যা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ করে নতুন চার্জযুক্ত কণা উৎপন্ন করতে পারে।
ডার্ক ম্যাটার নিয়ে গবেষণা শুধু বিজ্ঞানের কৌতূহল মেটানোর জন্য নয়, এটি মহাবিশ্বের প্রকৃত প্রকৃতি ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে। আমরা যদি ডার্ক ম্যাটারের স্বরূপ বুঝতে পারি, তাহলে হয়তো মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় রহস্যগুলোর একটি উন্মোচন হবে।
আগেই বলেছি, মহাবিশ্বের অপর অজানা রহস্যটি হচ্ছে, ডার্ক এনার্জি। ১৯৯৮ সালে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীদের দুটো পৃথক টিম দূরবর্তী এ ওয়ান টাইপ সুপারনোভার ঔজ্জ্বল্য নিয়ে গবেষণা করছিলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানে এ ধরনের সুপারনোভাকে স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এগুলোর ঔজ্জ্বল্য সবসময় স্থির অবস্থায় থাকে। এসব সুপারনোভার আলোক বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখতে পেলেন, দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোর ছুটে চলার গতি ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। এই যুগান্তকারী আবিস্কারটির পেছনে ছিলো তিনজন জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীর নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণা। এরা হলেন, অ্যাডাম রিস, সল পার্লমাটার এবং ব্রায়ান স্মিড।এই আবিস্কারটির জন্য ২০১১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে তাঁরা তিনজনই যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। মহাবিশ্বের এই তরান্বিত প্রসারণের ব্যাখ্যা দেয়া খুবই কঠিন কাজ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কোনো অদৃশ্য শক্তি গ্যালাক্সিগুলোকে ক্রমাগত দূর থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
এই অজানা শক্তির নাম বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন, ডার্ক এনার্জি। এর প্রভাবে গ্যালাক্সিগুলোর ছুটে চলার গতি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মহাশূন্যের সর্বত্রই রয়েছে ডার্ক এনার্জির সুষম অবস্থান। অন্যভাবে বলতে হয়, প্রকৃতপক্ষে এটি মহাশূন্যেরই একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মহাশূন্য আসলে শুন্য নয়, এর সর্বত্রই রয়েছে ডার্ক এনার্জি। এই রহস্যময় শক্তির প্রভাবেই গ্যালাক্সিগুলোর দূরে সরে যাবার গতি ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে। এক কথায় বলতে হয়, মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করছে এই ডার্ক এনার্জি। কিন্তু এই শক্তির উৎস সম্বন্ধে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন।
অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, মহাশূন্যের অসীম শূন্যতার মাঝে সর্বদাই কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের ফলে যে ভ্যাকুয়াম এনার্জির সৃষ্টি হচ্ছে সেটাই ডার্ক এনার্জির উৎস । কিন্তু এর স্বপক্ষে এখনো কোন পরীক্ষামূলক প্রমাণ নেই। তবে সাম্প্রতিককালে (২০২৩) একদল জ্যোতির্বিজ্ঞানী তাদের পর্যবেক্ষণে দেখেছেন, বিভিন্ন গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলগুলো একধরনের ভ্যাকুয়াম এনার্জির সৃষ্টি করছে। তাঁরা মনে করছেন, এইসব দানবাকৃতির ব্ল্যাকহোল থেকে ডার্ক এনার্জির সৃষ্টি হতে পারে। তবে এ বিষয়ে এখনো নিশ্চিতভাবে বলার সময় আসেনি। ডার্ক এনার্জির রহস্য এখনো অধরাই রয়ে গেছে।
ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি গবেষণায় সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। আগামী ২৪ থেকে ২৭ মার্চ, ২০২৫ তারিখে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস (ইউসিএলএ) 'ডার্ক ম্যাটার ২০২৫' শীর্ষক সম্মেলনের আয়োজন করছে। এই সম্মেলনে ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জির উৎস ও শনাক্তকরণ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে আলোচনা হবে। এ ধরনের সম্মেলন মহাবিশ্ব সম্বন্ধে আমাদের বোঝাপড়া আরও গভীর করতে সহায়তা করবে। হয়তো একদিন অদৃশ্য এই জগত আমাদের সামনে উন্মোচিত হবে।
© তানভীর হোসেন
Comments