ওয়ার্প ড্রাইভ: মহাকাশ যাত্রার শর্টকাট?

আমাদের ছোটবেলায় টিভিতে একটিই চ্যানেল ছিল। সেটি হলো সবেধন নীলমণি বিটিভি। চ্যানেলটি ছিল সাদা কালো। সন্ধ্যা থেকে সম্প্রচার শুরু হয়ে মাঝরাত পর্যন্ত চলতো। তখন এটিই ছিল আমাদের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। সেই সময় বিটিভিতে বেশ কিছু ভালো ভালো ইংরেজি সিরিজ দেখানো হতো। তার মধ্যে একটি ছিল "স্টার ট্রেক"। আমার খুব প্রিয় একটি সায়েন্স ফিকশন সিরিজ। এই কাহিনীর মহাকাশচারীরা স্টারশীপ এন্টারপ্রাইজে চড়ে গ্যালাক্সির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়াতেন। ‌ নতুন নতুন গ্রহে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়তেন। তারপর বুদ্ধি খাটিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, তাদের মহাকাশযানটি আলোর গতির চেয়েও অনেক বেশি গতিতে চলতে পারতো।‌ এর ফলে নিমেষের মধ্যেই গ্যালাক্সির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তাঁরা পৌঁছে যেতে পারতেন। এক্ষেত্রে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হতো, তার নাম হলো, ওয়ার্প ড্রাইভ (warp drive)। তবে "স্টার ট্রেক" ছিল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। কল্পনায় অনেক কিছুই সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে কি আলোর গতির চেয়ে বেশি গতিতে চলা সম্ভব?  বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয়, সুপার ল্যুমিনাল ট্রাভেল। ‌দেখা যাক, বিজ্ঞান এ ব্যাপারে কি বলে?

আইনস্টাইন বলেছেন, আলোর গতিই হলো বস্তুর সর্বোচ্চ গতিসীমা। আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে ২৯৯,৭৯২ কিলোমিটার, অর্থাৎ সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটারের কাছাকাছি। এর চেয়ে বেশি গতিতে কোন বস্তু চলতে পারে না। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব অনুসারে, আলোর গতিতে চললে কোন বস্তুর ভর হয়ে যাবে অসীম, দৈর্ঘ্য হয়ে যাবে শূন্য। ‌সময় যাবে থেমে।  আলোর গতির চেয়ে বেশি গতি অর্জন করা কোন বস্তুর পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষের তৈরি মহাকাশযানের গতি আলোর গতির ধারে কাছেও নয়। 

১৯৭৭ সালে উৎক্ষেপিত নাসার মহাকাশযান "ভয়েজার ২" এখন সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে  আন্ত:নাক্ষত্রিক মহাশূন্যে প্রবেশ করেছে। এর গতি প্রতি সেকেন্ডে ১৫.৪ কিলোমিটার। এটি আলোর গতির একটি অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ  (০.০০০০৫%) মাত্র। এই গতিতে চললে, সূর্যের  নিকটতম প্রতিবেশী নক্ষত্র, প্রক্সিমা সেন্টারাইতে পৌঁছাতে "ভয়েজার ২" এর সময় লাগবে ৭০ হাজার বছর। অথচ আলোর গতিতে চলতে পারলে মাত্র সাড়ে চার বছরেই এই দুরত্বটুকু পাড়ি দেওয়া যেত। 

সৌরজগতের বাইরের মহাবিশ্বে ভ্রমণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হলো নক্ষত্রদের মাঝের অচিন্তনীয় দূরত্ব। পৃথিবী থেকে হাজার কোটি আলোকবর্ষ দূরেও অনেক নক্ষত্র রয়েছে। এই সুবিশাল দূরত্বকে অতিক্রম করার মত কোন প্রযুক্তি মানুষের কাছে নেই। আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে চলার মত কোন মহাকাশযান  মানুষ এখনো আবিষ্কার করতে পারে নি। তবে এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে। 

১৯৯৪ সালে মেক্সিকান  পদার্থবিজ্ঞানী মিগুয়েল এলকুবিয়ের এক গবেষণাপত্রে আলোর গতির চেয়ে বেশি গতিতে চলার একটি অভিনব পদ্ধতির তাত্ত্বিক ধারণা দিয়েছিলেন। একে বলা হয়, এলকুবিয়ের ওয়ার্প ড্রাইভ। বলাই বাহুল্য, "ওয়ার্প ড্রাইভ" নামটি "স্টার ট্রেক" টিভি সিরিজ থেকেই নেয়া হয়েছে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের ফিল্ড সমীকরণ সমাধান করে তিনি এই পদ্ধতিটির গাণিতিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁর এই গাণিতিক সমাধানটি ছিল মেট্রিক টেন্সরের উপর ভিত্তি করে, সেজন্য একে এলকুবিয়ের মেট্রিকও বলা হয়ে থাকে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি, আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব অনুসারে স্থান এবং কালের যৌথ বুননেই মহাবিশ্বের অবকাঠামো গঠিত হয়েছে। একে বলে স্পেস-টাইম। বাংলায় স্থান-কাল বলা যেতে পারে। স্থান-কালকে একটি রাবারের চাদরের সাথে তুলনা করা হয়। আইনস্টাইন বলেছেন, বস্তুর উপস্থিতিতে স্থান-কালের চাদরে এক ধরনের কার্ভেচার বা বক্রতার সৃষ্টি হয়। এই বক্রতাটিকেই আমরা মহাকর্ষ বল হিসেবে দেখি। যে বস্তুর ভর যত বেশি তার চারপাশে স্থান-কালের চাদরে বক্রতার পরিমানও তত বেশি। সেজন্য মহাকর্ষ বল বস্তুর ভরের উপর নির্ভর করে। আইনস্টাইনের মতে স্থান-কালের চাদরে মহাকর্ষ একটি জ্যামিতিক ব্যাপার। 

এলকুবিয়ের তাঁর প্রস্তাবিত ওয়ার্প ড্রাইভে এক ধরনের নেগেটিভ এনার্জি ব্যবহারের কথা বলেছেন। কোয়ান্টাম শূন্যতার মাঝে যে শুন্য এনার্জি থাকে, এটি তার চেয়েও অনেক কম এনার্জি। আমরা জানি, শূন্য এনার্জি মানে যেখানে কোনো শক্তি নেই। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে, শূন্য অবস্থা থেকেও কম শক্তি থাকা সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ক্যাসিমির এফেক্ট।যেখানে শূন্যস্থানে থাকা দুটি ধাতব প্লেট একে অপরের দিকে আকৃষ্ট হয় শুধুমাত্র শূন্যস্থানের কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের কারণে। এই আকর্ষণের পেছনে দায়ী নেগেটিভ এনার্জি। তবে, এখনো পর্যন্ত নেগেটিভ এনার্জি কেবল তাত্ত্বিকভাবেই প্রমাণিত হয়েছে, বাস্তবে এটি বড় পরিসরে তৈরি করা সম্ভব হয়নি। 

এলকুবিয়ের তাত্ত্বিকভাবে দেখিয়েছেন, নেগেটিভ এনার্জি প্রয়োগ করলে অত্যন্ত শক্তিশালী মহাকর্ষীয় বলের ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। এর মাধ্যমে মহাকাশযানের আশপাশের স্থান-কালকে দুমড়ে ফেলা সম্ভব। তাঁর প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে,  মহাকাশযানের সামনের দিকে স্থান-কাল সংকুচিত হয়ে যাবে এবং পেছনের দিকে স্থান-কাল প্রসারিত হবে। এর ফলে, মহাকাশযানের চারপাশে একটি "ওয়ার্প বাবল" তৈরি হবে এবং তখন এটি আলোর গতির চেয়েও অনেক বেশি দ্রুতগতিতে দূরবর্তী কোন নক্ষত্রের কাছে অনায়াসে পৌঁছে যেতে পারবে। আপনি হয়তো ভাবছেন, আলোর গতির চেয়ে বেশি গতিতে চলা তো প্রাকৃতিকভাবেই সম্ভব নয়, তাহলে এটি  সম্ভব হবে কিভাবে? 

প্রকৃতপক্ষে মহাকাশযানটি আদৌ আলোর গতির চেয়ে বেশি গতিতে চলবে না। এর প্রকৃত গতি আলোর গতির চেয়ে অনেক কম হবে। কিন্তু এর সামনে ও পেছনে স্থান-কালের চাদর দুমড়ে মুচড়ে যাওয়ার ফলে দূরবর্তী নক্ষত্রগুলো মহাকাশযানের কাছাকাছি চলে আসবে। সেজন্যই মহাকাশযানটি দ্রুত সেখানে পৌঁছে যেতে পারবে। মোদ্দা কথা হলো, এই পদ্ধতিতে নক্ষত্ররাজি এবং মহাকাশযানের মাঝখানের দূরত্বকে কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। এটি হলো মহাকাশ ভ্রমণের একটি শর্টকাট রাস্তা। ‌আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব মেনেই এটি তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব। এখানে এলকুবিয়ের কোন প্রাকৃতিক নিয়ম ভঙ্গ করেন নাই। 

একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি বুঝতে আরো সহজ হবে। মনে করুন, বিশাল বড় কার্পেটের মাঝামাঝি একটি চায়ের কাপ রাখা হয়েছে। আপনাকে কাপটি আনতে হবে। আপনি দু'ভাবে এটি করতে পারেন। ‌এক হলো আপনি কার্পেটের উপর হেঁটে গিয়ে কাপটি নিয়ে আসতে পারেন। অথবা কার্পেটটিকে গুটিয়ে নিয়ে কাপটি আপনার নিজের দিকে টেনে আনতে পারেন। অর্থাৎ আপনাকে কষ্ট করে কাপের কাছে যেতে হবে না, কাপই আপনার কাছে চলে আসবে! এলকুবিয়ের এই দ্বিতীয় পন্থার কথাই বলেছেন।  তিনি তাঁর গবেষণাপত্রে নেগেটিভ এনার্জি ব্যবহার করে স্থান-কালের চাদরকে আলোর গতির চেয়েও দ্রুত গুটিয়ে আনার প্রস্তাবনা করেছেন। আলোর সর্বোচ্চ গতিসীমাটি বস্তুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও, স্থান-কালের প্রসারণ বা সংকোচনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। মনে রাখতে হবে, মহাবিশ্বের সূচনায় স্থান-কাল আলোর গতির চেয়েও অনেক বেশি দ্রুতগতিতে স্ফীত হয়ে উঠেছিলো। 

পুরো ব্যাপারটিকে স্টার ট্রেকের মত সায়েন্স ফিকশন মনে হলেও, পদার্থবিজ্ঞানীরা মনে করেন তাত্ত্বিকভাবে এটি করা সম্ভব। তবে বাস্তবে এটি সম্ভব কিনা এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে।

এলকুবিয়েরের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হবার পর, অনেক বিজ্ঞানী এই বিষয়টি নিয়ে আগ্রহী হয়েছেন। তাঁরা হিসেব করে দেখেছেন, স্থান-কালের চাদরকে দুমড়ে মুচড়ে দেওয়ার পদ্ধতিটিকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে যে পরিমাণ নেগেটিভ এনার্জি দরকার হবে তার কোন সম্ভাব্য উৎস বর্তমানে বিজ্ঞানীদের  জানা নেই। 

গত সিকি শতাব্দী ধরেই বিজ্ঞানীরা ওয়ার্প ড্রাইভের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করছেন। বছর চারেক আগে "ক্লাসিক্যাল এন্ড কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি"  (মার্চ, ২০২১) জার্নালে, এ ব্যাপারে দু'জন বিজ্ঞানীর একটি ‌গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। এ দু'জন বিজ্ঞানীর নাম হলো, এলেক্সি ববরিক এবং জিয়ান্নি
মার্ত্রিরে। তাঁরা দাবি করেছেন, নেগেটিভ এনার্জি ব্যবহার করা ছাড়াই, পজিটিভ এনার্জি দিয়েই ওয়ার্প ড্রাইভ নির্মাণ করা সম্ভব। তবে তাঁদের প্রস্তাবিত ওয়ার্প ড্রাইভে যে পরিমাণ পজেটিভ এনার্জি লাগবে সেটাও বর্তমানে মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হবার পর, ওয়ার্প ড্রাইভ নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে আবার নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।  অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স নামে একটি যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। তবে তারা এখনো সাব ল্যুমিনাল অর্থাৎ আলোর গতির চেয়ে কম গতি সম্পন্ন ওয়ার্প ড্রাইভের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করছে। 

অতীতের মানুষের অনেক  কল্পনাকেই বাস্তবায়িত করেছে বর্তমানের বিজ্ঞান। অতীতে যেটা ছিল অলীক কল্পনা বর্তমানে সেটাই এখন বাস্তব। ‌সেজন্য বর্তমানের কল্পনা যে ভবিষ্যতে বাস্তবে রূপ নেবে না, সেটা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। বর্তমানের মানুষের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীকে বাস্তবে রূপ দেবে ভবিষ্যতের বিজ্ঞান, এই আশা করাই যায়। 

ওয়ার্প ড্রাইভ নিয়ে অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সের গবেষণা সংক্রান্ত তথ্য পেতে হলে এই ওয়েবসাইটে ক্লিক করুন 

https://appliedphysics.org/warp-drive/

Comments