এনট্রপি ও সময়ের স্রোত


সময় যেন এক  বিশাল গভীর নদীর মতো, প্রবাহমান এবং নিরবচ্ছিন্ন। আমরা সেই নদীর স্রোতে ভেসে চলেছি। কেউ সচেতন, কেউ বা অন্যমনস্ক, কেউ স্রোতের টানে ভাসছি, কেউ বা সাঁতার কাটার চেষ্টা করছি। সময়ের এই স্রোত কেবল সামনের দিকে এগোয়, কখনোই পেছনে ফেরে না। এই সাধারণ সত্যের পেছনে লুকিয়ে আছে এক গভীর, অথচ নিঃশব্দ প্রাকৃতিক নিয়ম। এর নাম, এনট্রপি।

এনট্রপি মূলত প্রাকৃতিক বিশৃঙ্খলার পরিমাপ। তাপ গতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রে এর দেখা পাওয়া যায়। এটি বিজ্ঞানের পরিভাষা হলেও, আমরা প্রতিনিয়তই এর মুখোমুখি হচ্ছি। একে সহজ করে বোঝানো যায় একটি ঘরের উদাহরণ দিয়ে। মনে করুন একটি ঘর পরিষ্কার করে সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। বিছানাটা ছিমছাম পরিপাটি, জামা কাপড়  ভাঁজ করা, বইপত্র রয়েছে তাকে, সবকিছু একদম ঠিকঠাক জায়গায়। তাহলে বলতে হবে, সেই ঘরটি রয়েছে কম এনট্রপির অবস্থায়। কিন্তু কিছুদিন পর, ঘরের কোন  যত্ন না নেয়া হলে, ঘরটি ধীরে ধীরে অগোছালো হয়ে যাবে। ঘরের মেঝেতে ধুলো জমবে, বই ছড়িয়ে যাবে, বিছানাপত্র, কাপড় চোপড় সব এলোমেলো হয়ে যাবে। অর্থাৎ ঘরের বিশৃঙ্খলা বেড়ে যাবে। এটাই এনট্রপির কাজ, গুছানো অবস্থা থেকে বিশৃঙ্খলার দিকে এগিয়ে যাওয়া।

যত বেশি বিশৃঙ্খলা, তত বেশি এনট্রপি। যেমন ধরুন, একটি ডিম যদি হঠাৎ করে হাত থেকে মেঝেতে পড়ে ভেঙে যায়, সেটা হবে একদম স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু ডিমটা মেঝে থেকে লাফিয়ে উঠে আস্ত হয়ে হাতে ফিরে এলে সেটা হবে অস্বাভাবিক। কারণ এতে এনট্রপি কমে যাচ্ছে—যা প্রকৃতি স্বাভাবিক নিয়মেই হতে দেবে না। এমন বহু উদাহরণ আছে আমাদের চারপাশে। গরম চা ঠান্ডা হয়ে যায়, কিন্তু ঠান্ডা চা হঠাৎ গরম হয় না। অগোছালো ঘর নিজে থেকে গুছিয়ে উঠে না। আমাদের 
শরীর বুড়ো হয়, কিন্তু হঠাৎ করে তরুণ হয় না। বাড়ি ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে, কিন্তু পড়ে গিয়ে নিজে থেকে আবার তৈরি হয় না। এইসব ঘটনার গোপন চালক হলো, এনট্রপি।

বিজ্ঞানের অনেক নিয়ম আছে, যেমন—নিউটনের সূত্র, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা,  কোয়ান্টাম মেকানিক্স। এসব বৈজ্ঞানিক নিয়ম সময়কে সামনে বা পেছনে যেতে বাঁধা দেয় না। মানে, সূত্রগুলোকে উল্টো করে চালালেও তাত্ত্বিকভাবে সমস্যা হয় না। কিন্তু বাস্তবে আমরা সময়কে কেবল সামনের দিকেই এগোতে দেখি। কারণ বাস্তব জগতে শুধু একটি প্রাকৃতিক নিয়ম সময়কে একমুখী করে তোলে। আর সেটাই হচ্ছে বিশৃঙ্খলার নিয়ামক, এনট্রপি। 

এই বিশৃঙ্খলার নিয়ম কাজ করে আমাদের শরীরে, স্মৃতিতে, জীবনযাত্রায়, এমনকি পুরো মহাবিশ্বেও। সময় যত এগোয়, এনট্রপি তত বাড়ে। এজন্য অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, সময়ের সাথে এনট্রপির সরাসরি একটি যোগসূত্র রয়েছে। এনট্রপির কারণেই সময় কেবল একমুখী হয়ে ওঠে। এই এনট্রপির প্রবাহই তৈরি করে সময়ের তীর। যা ফিরে আসে না, বরং কেবল সামনের দিকে ছুটে চলে। অতীতে কখনো ফেরা যায় না। সর্বদাই আমরা ছুটে চলেছি অজানা এক ভবিষ্যতের দিকে।

আমাদের স্মৃতিগুলোও এই নিয়মের বাইরে নয়। ছোটবেলার কিছু দৃশ্য, গন্ধ, মুখ মনে পড়ে ঠিকই। কিন্তু সেই স্মৃতির সময় আর ফিরে আসে না। স্মৃতি যেন সর্বনাশা এনট্রপির বিরুদ্ধে একটি সামান্য প্রতিরোধ। আমরা ছবি তুলে রাখি, ডায়েরি লিখি, গান গাই, গল্প বলি—সবই সেই হারিয়ে যাওয়া সময়ের ভয় থেকে। সময়কে কিছুটা ধরে রাখার চেষ্টা। কিন্তু সময় তার নিজের নিয়মেই ধীরে ধীরে স্মৃতিগুলোকে ঝাপসা করে দেয়। কোনটা সত্যি ছিল, কোনটা ছিল কল্পনা—তা মিলেমিশে এক অদ্ভুত ধোঁয়াশা হয়ে যায়।

আর সময়ের সবচেয়ে নির্দয় রূপ হলো মৃত্যু। এনট্রপির চূড়ান্ত বাস্তবায়ন। যেখানে শরীর থেমে যায়, স্পন্দন স্তব্ধ হয়, জীবন প্রদীপ নিভে আসে। একটা জীবন যা একসময় প্রাণবন্ত ছিল, ভালোবাসা পেয়েছিল, ভুল করেছিল, স্বপ্ন দেখেছিল, সেটি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু তারপরও আমরা মৃত মানুষের গল্প বলি, কবরে ফুল রাখি, নাম খোদাই করি, প্রার্থনা করি। অন্তত তার কিছুটা স্মৃতি, কিছুটা অস্তিত্ব ধরে রাখার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। এ সবই এনট্রপির বিরুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত  প্রতিরোধ। 

সময় ও এনট্রপির একমুখী স্রোতের মাঝেও আমরা গড়ে তুলেছি প্রযুক্তির বেড়া। আমরা বানিয়েছি স্মৃতি সংরক্ষণের ক্যামেরা, তথ্য রাখার হার্ডড্রাইভ। আমরা চেষ্টা করছি ডিএনএ মেরামত করে বয়সকে থামাতে, পুরোনো জিনিসকে নতুন করে তুলতে। এমনকি এখন আমরা মস্তিষ্কের সব তথ্য ডাউনলোড করে ডিজিটাল আকারে সংরক্ষণের স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু প্রযুক্তিও অমর নয়। পুরোনো ফোন ধীর হয়ে যায়, ডেটা হারিয়ে যায়, মেমোরি কার্ড নষ্ট হয়। অর্থাৎ, প্রযুক্তিও এনট্রপির নিয়মে বাঁধা। তবুও আমাদের থেমে যাওয়া নেই। কারণ এনট্রপির বিপরীতে চলার প্রচেষ্টাই আমাদেরকে মানুষ করে তোলে।

সময়, স্মৃতি, মৃত্যু এবং প্রযুক্তি—এগুলো আলাদা নয়। সবই এক সুতোয় গাঁথা, একে অন্যের পরিপূরক। এনট্রপি হয়তো বলে, সবই বিশৃঙ্খলার দিকে এগোবে। তবুও মানুষ প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে কিছুটা গুছিয়ে রাখার, কিছুটা ধরে রাখার। কেউ ভালোবাসা ধরে রাখে, কেউ ইতিহাস, কেউ বা বিজ্ঞান। 

এই একমুখী সময়ের পথে হাঁটতে হাঁটতেই মানুষ জীবনকে অর্থ দেয়, হারানোর মধ্যেও খুঁজে নেয় সৌন্দর্য। আর সেই অর্থই সময়কে আমাদের কাছে মূল্যবান করে তোলে। শেষমেশ, আমরা সবাই সময়ের স্রোতে ছুটে চলেছি, এনট্রপির অমোঘ নিয়মে, স্মৃতির ভারে, মৃত্যুর প্রহরে, প্রযুক্তির আশায়। এই অনন্ত অগস্ত্য যাত্রায়  ফেরার কোন পথ নেই।

Comments