এই গল্পের সূচনা ১৯১৫ সালে। সেই বছর বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর কালজয়ী জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন। এই তত্ত্বে বলা হয়েছে, মহাবিশ্বে স্থান এবং কাল একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। স্থান-কালের যৌথবুননেই মহাবিশ্বের অবকাঠামো গঠিত হয়েছে। আইনস্টাইন তাঁর এই তত্ত্বে আরো বলেছেন, বস্তুর ভরের কারণে স্থান-কালের বুননের মাঝে এক ধরনের বক্রতার সৃষ্টি হয়। স্থান-কালের এই বক্রতাটিই হলো মহাকর্ষ বলের উৎস। যে বস্তুর ভর যত বেশি হবে তার চারপাশে স্থান-কালের চাদরে বক্রতার পরিমাণও তত বেশি হবে। সেজন্য তার মহাকর্ষ বলও হবে তত বেশি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সূর্যের উপস্থিতিতে এর চারপাশে স্থান-কালের চাদরে যে বক্রতাটি সৃষ্টি হয়েছে সেটিকে অনুসরণ করেই পৃথিবী সহ অন্যান্য গ্রহ সূর্যকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করছে। এভাবেই তিনি নিউটনের আবিষ্কৃত মহাকর্ষ বলের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বকে সেজন্য বলা হয়, আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব। তাঁর এই তত্ত্ব মতে, মহাবিশ্বে স্হান-কাল এক অভিন্ন সত্ত্বা এবং মহাকর্ষ হলো স্থান-কালেরই একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এটি মূলত একটি জ্যামিতিক ব্যাপার।
সেই সময় আইনস্টাইন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, কোন বিশাল দুটো মহাজাগতিক বস্তুর মধ্যে যদি সংঘর্ষ হয়, তাহলে তার চারপাশের স্থান-কালের চাদরে এক ধরনের ঢেউ তৈরি হবে। এই ঢেউগুলোই হচ্ছে, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে যেমন তার চারপাশে ঢেউ তৈরি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ঠিক তেমনি ভাবেই দুটো ব্ল্যাকহোলের মধ্যে সংঘর্ষ হলে স্থান-কালের চাদরে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সৃষ্টি হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সমস্যা হলো, এই তরঙ্গ এতই ক্ষীণ যে, পৃথিবী থেকে এটি শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব। তাই, মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের এই ভবিষ্যদ্বাণী দীর্ঘদিন শুধুমাত্র তত্ত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে চেষ্টা করেছেন মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করার জন্য। গত শতাব্দীর ৭০ এর দশকে, বিজ্ঞানীরা বাইনারি নিউট্রন নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে এর প্রমাণ পেলেও, সরাসরি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত হয়, লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজারভেটরি, সংক্ষেপে যার নাম লাইগো (LIGO)। এটি অত্যন্ত সংবেদনশীল এক যন্ত্র, যা মহাবিশ্বের দূরবর্তী স্থান থেকে আসা ক্ষীণতম কম্পনও শনাক্ত করতে পারে।
আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রকাশের ১০০ বছর পর, ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো দুটি বিশাল ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষ থেকে উৎপন্ন মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে শনাক্ত করতে সক্ষম হন। এটি ছিল প্রায় এক বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের ঘটনা! ২০১৬ সালে বিজ্ঞানীরা ঘোষণা দেন, তাঁরা প্রথমবারের মতো সরাসরি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করেছেন। এই আবিষ্কারের জন্য রেইনার ওয়েইস, ব্যারি সি. ব্যারিশ ও কিপ এস. থর্ন ২০১৭ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
লাইগো মূলত একটি এল-আকৃতির বিশাল ইন্টারফেরোমিটার, যার দুটি চার কিলোমিটার লম্বা টানেল আকৃতির বাহু রয়েছে। এটি লেজার রশ্মি ব্যবহার করে মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে শনাক্ত করে। প্রথমে একটি শক্তিশালী লেজার রশ্মি ছোড়া হয়, যা একটি বিম স্প্লিটারের মাধ্যমে দুটি আলাদা পথে ভাগ হয়ে যায়। এই দুটি রশ্মি লাইগোর দুইটি দীর্ঘ টানেলের শেষ প্রান্তে যায় এবং সেখানে রাখা আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে। ফিরে আসা দুটি রশ্মি আবার একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে এসে মিলিত হয়। যদি সেই সময় কোনো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ পৃথিবীর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তাহলে স্থান-কাল সামান্য বিচ্যুত হবে, যার ফলে লাইগোর বাহু দুটোর দৈর্ঘ্যে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ঘটবে। এই পরিবর্তন এতটাই ক্ষুদ্র যে সাধারণভাবে তা বোঝা যায় না। কিন্তু লেজার রশ্মির পথের অতিসামান্য পার্থক্য হলেও সেটা এক বিন্দুতে এসে মিলবে না। তখন লাইগোর সেন্সর সেটা শনাক্ত করতে পারে। যদি দুটি লেজার রশ্মি একসাথে এক বিন্দুতে সঠিকভাবে না মেলে, তাহলে বোঝা যায়, কোনো মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রভাবেই এই বিচ্যুতি ঘটেছে। এই অসাধারণ প্রযুক্তির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষ, নিউট্রন নক্ষত্রের মিলন, এমনকি মহাবিশ্বের আদিকালের রহস্যের সন্ধান করছেন।
লাইগোর পরবর্তী সময়ে নির্মিত ইতালির ভারগো (VIRGO) এবং জাপানের কাগরা (KAGRA) ব্যবহার করেও বিজ্ঞানীরা এখন মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সন্ধান করে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত দুইশ'র বেশি মহাকর্ষ তরঙ্গকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে ব্যবহার করে মহাবিশ্বের অনেক অজানা রহস্যের পর্দা তুলতে ব্যস্ত। একসময় যে বিষয়গুলো কেবল অনুমানের ওপর নির্ভর করতো, এখন সেগুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। ব্ল্যাকহোল নিয়ে বিজ্ঞানীদের কৌতূহল তো চিরকালই ছিল। কিন্তু মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কারের পর তাঁরা এখন আরও ভালোভাবে বুঝতে পারছেন, কীভাবে ব্ল্যাকহোল তৈরি হয়, কীভাবে তারা পূর্ণতা পায়, আর তাদের আচরণ কেমন। শুধু তাই নয়, মহাবিশ্ব যেভাবে ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে, সেটা নিয়েও এখন নতুন নতুন গবেষণা চলছে। ডার্ক এনার্জি বা সেই রহস্যময় অজানা শক্তি, যা মহাবিশ্বের সম্প্রসারণকে ত্বরান্বিত করছে, সেটার প্রকৃতি বুঝতেও মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।
এছাড়া বিজ্ঞানীরা এখন চেষ্টা করছেন আমাদের মহাবিশ্বের একদম প্রাথমিক সময়ের সংকেত খুঁজে বের করতে। অর্থাৎ যে সময় বিগ ব্যাং হয়েছিল, তখন যদি কোনো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ তৈরি হয়ে থাকে, সেগুলোর চিহ্ন খুঁজে বের করা যায় কিনা, তা নিয়ে গবেষণা চলছে। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এখন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।
এইসব গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন ডিটেক্টর তৈরির পরিকল্পনা করছেন। ভবিষ্যতে মহাকাশে বসানো হবে LISA (লেজার ইন্টারফেরোমিটার স্পেস এন্টেনা)
নামে একটি ডিটেক্টর, যা আগের চেয়েও অনেক বেশি সংবেদনশীল হবে। এই যন্ত্র দিয়ে আরও দূরবর্তী, আরও দুর্বল মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধরা যাবে, যেগুলো আমাদের মহাবিশ্বের জন্ম ও বিবর্তন সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য এনে দেবে। এককথায় বলা যায়, মহাবিশ্বের গল্প বলা এখন শুধু আলো আর রেডিও তরঙ্গের ওপর নির্ভরশীল নয়। মহাকর্ষীয় তরঙ্গও হয়ে উঠছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক নতুন ভাষা, যার সাহায্যে আমরা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি মহাবিশ্বের প্রকৃত চেহারা।
© তানভীর হোসেন
Comments