ইউরোপিয়ান রবিনের "কোয়ান্টাম" চোখ


প্রতি বছর বসন্ত এলে ইউরোপের বাগান, পার্ক আর বনভূমিতে ছোট্ট পাখি, রবিনের কিচিরমিচির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু শীত এলেই এরা পাড়ি জমায় উত্তর আফ্রিকার উষ্ণ অঞ্চলের দিকে। এত দীর্ঘ পথ পেরিয়ে, নদী-নালা, সমুদ্র-পর্বতের বাঁধা অতিক্রম করে তারা কীভাবে তাদের পথ খুঁজে পায়? ওদের কাছে তো কোন গুগল ম্যাপ বা জিপিএস নেই! তবুও ইউরোপিয়ান রবিন পাখিগুলো হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে গিয়ে ঠিক ঠিক তাদের গন্তব্যে পৌঁছে যায়।

বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে এই রহস্যের উত্তর খুঁজছিলেন। তাদের ধারণা, এর রহস্য লুকিয়ে আছে প্রকৃতির এক অদ্ভুত শক্তির মধ্যে। অবশেষে তাঁরা এক অবিশ্বাস্য সত্য আবিষ্কার করেছেন। সেটা হলো, এই পাখিরা সম্ভবত কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সহায়তায় একটি অদৃশ্য কম্পাসের মাধ্যমে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র অনুভব করতে পারে!

অবশ্য অনেক প্রাণীই পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র অনুভব করতে পারে, যেমন কচ্ছপ, মাছ এবং কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণী। তবে ইউরোপিয়ান রবিনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি আরও রহস্যময়। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এই পাখিগুলো শুধুমাত্র চৌম্বক ক্ষেত্রের উপস্থিতি অনুভব করে না, বরং তারা চৌম্বকীয় উত্তর ও দক্ষিণ মেরু চিহ্নিত করতে পারে এবং সেটা ব্যবহার করেই দিক নির্ধারণ করে।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে, এর মূল রহস্য লুকিয়ে আছে তাদের চোখের রেটিনায় থাকা এক বিশেষ আলোক-সংবেদনশীল প্রোটিনের মধ্যে, যার নাম ক্রিপ্টোক্রোম। সূর্যের নীল আলো যখন এই প্রোটিনে পড়ে, তখন এটি এক বিস্ময়কর কোয়ান্টাম প্রক্রিয়া শুরু করে। এর নাম, রেডিকাল পেয়ার মেকানিজম। ক্রিপ্টোক্রোমের প্রোটিন অণু যখন সূর্যের আলো শোষণ করে, তখন এর ভেতর থেকে ইলেকট্রনের একটি জোড়া পৃথক হয়ে যায়। কিন্তু এরা থাকে কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেল্ড অবস্থায়। এর মানে হচ্ছে, তারা স্থানিকভাবে আলাদা হলেও অদৃশ্য এক বন্ধনে তারা পরস্পরের সাথে বিজড়িত অবস্থায় থাকে।  একটি ইলেকট্রনের অবস্থার পরিবর্তন হলে অন্যটিও তাৎক্ষণিকভাবে পরিবর্তিত হয়। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের উপস্থিতিতে, এই এন্টেঙ্গেল্ড  ইলেকট্রনগুলোর স্পিন পরিবর্তিত হয়। এটা ক্রিপ্টোক্রোম প্রোটিনের রাসায়নিক পরিবর্তনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এই পরিবর্তন মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায় এবং পাখিটিকে বলে দেয় কোন দিকটি উত্তর আর কোন দিকটি দক্ষিণ। এই পুরো প্রক্রিয়াটি হয় একেবারে সূক্ষ্ম ও তাৎক্ষণিকভাবে। সাধারণত ইলেকট্রনের কোয়ান্টাম অবস্থা খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়ে হলো, রবিনদের চোখের ক্রিপ্টোক্রোমের এন্টেঙ্গেল্ড  ইলেকট্রনগুলো বেশ স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে। এটি একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, যদি এই পাখিদের চোখে বিশেষ আলোর এক্সপোজার বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে ওরা আর দিকনির্ণয় করতে পারে না। আবার, যদি একটি কৃত্রিম চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা হয় এবং সেটার দিক পরিবর্তন করা হয়, তাহলে রবিনেরাও সেই পরিবর্তন অনুভব করে এবং নতুনভাবে নিজেদের দিক নির্ধারণ করে।

আরও আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, বিজ্ঞানীরা যখন ক্ষুদ্র চৌম্বকীয় তরঙ্গ ব্যবহার করে কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট নষ্ট করার চেষ্টা করেন, তখন পাখিরা সম্পূর্ণভাবে পথ হারিয়ে ফেলে। এই পরীক্ষা নিশ্চিত করে যে, এই পাখিরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্যেই পথ খুঁজে পায়!

তবে মনে রাখতে হবে, রবিনরা শুধুমাত্র কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ওপর নির্ভর করে না। তারা সূর্যের অবস্থান, তারার বিন্যাস, এবং ভিজুয়াল ল্যান্ডমার্কিং (চেনা নদী, বন, পর্বত) ব্যবহার করেও পথ খুঁজে পায়। দিনের বেলা সূর্যের অবস্থান দেখে তারা দিক নির্ধারণ করতে পারে, আর রাতের আকাশে নক্ষত্র দেখে পথ চিনতে পারে।
অভিজ্ঞ পাখিরা তাদের পূর্ববর্তী যাত্রার অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে চেনা নদী, পাহাড়, বা বনভূমি দেখে পথ চিনতে পারে। তবে তাদের চোখের চৌম্বকীয় সংবেদনশীলতা পথচলায় ক্ষেত্রে এক অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে। 

এই গবেষণা শুধু পাখিদের দিকনির্দেশনার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি কোয়ান্টাম বায়োলজি নামে এক নতুন বিজ্ঞানের দ্বার খুলে দিয়েছে। এর আগে বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্স শুধুমাত্র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণাদের জগতে কাজ করে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, জীবজগতও কোন কোন ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম কানুন ব্যবহার করছে।

ইউরোপিয়ান রবিনের কোয়ান্টাম চোখের সব রহস্য এখনো উদঘাটিত হয়নি। সবচেয়ে বড় রহস্য হলো, কীভাবে সাধারণ তাপমাত্রায় এন্টেঙ্গেল্ড ইলেকট্রনগুলো স্থিতিশীল থাকে? এই রহস্য উদঘাটন করা গেলে, একে কাজে লাগিয়ে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার সহ অন্যান্য কোয়ান্টাম প্রযুক্তি ব্যবহার করার কাজটি অনেক সহজ হয়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে এখন আরো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, আর আমরা রয়েছি নতুন নতুন বিস্ময়ের অপেক্ষায়।





Comments