আলো থেকে সুপারসলিড: এক বৈজ্ঞানিক বিপ্লব

সম্প্রতি পদার্থবিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো আলোকে একটি "সুপারসলিড" পদার্থে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছেন। সুপারসলিড এমন এক ধরনের পদার্থ, যা একই সঙ্গে কঠিন এবং তরলের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। 

সাধারণত পদার্থের কঠিন, তরল ও বায়বীয় এই তিনটি অবস্থা আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। কিন্তু প্রকৃতিতে পদার্থের এমন কিছু অবস্থা রয়েছে, যা এই প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। সুপারসলিড এমনই এক অবস্থা, যেখানে কণাগুলো কঠিন পদার্থের মতোই একটি নির্দিষ্ট  কাঠামো ধরে রাখে। কিন্তু একই সাথে ঘর্ষণহীন তরল পদার্থের মতো প্রবাহিত হতে পারে। সাধারণ পদার্থের গুণাবলীর সঙ্গে এর বৈশিষ্ট্য মেলে না।

সুপারসলিড সম্পর্কে গবেষণা অনেক দিন থেকেই চলছে। তবে এতদিন এটি কেবলমাত্র পরমাণুর মাধ্যমে তৈরি করা সম্ভব ছিল। কিন্তু এবার প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীরা আলো ও পদার্থকে সংযুক্ত করে সুপারসলিড তৈরি করেছেন। এই গবেষণার মূল নায়ক হলো "পোলারিটন" নামের একটি কণা, যেটা আলো (ফোটন) এবং পদার্থের মৌলিক কণিকার (যেমন এক্সিটন বা ফনন) মিথস্ক্রিয়ার ফলে সৃষ্টি হয়। এটি আলো ও পদার্থের এক অনন্য মিলন, যেখানে আলো কণার সঙ্গে শক্তি বিনিময় করে এবং এক ধরনের হাইব্রিড অবস্থা তৈরি হয়। 

এই গবেষণাটি করেছেন ইতালির সিএনআর ন্যানোটেক এবং 
পাভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। গবেষকরা বিশেষ ধরনের লেজার এবং সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার করে এই পোলারিটন কণাকে এমনভাবে সাজিয়েছেন, যাতে এটি সুপারসলিডের বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে। তাঁরা এই পরীক্ষার জন্য একটি অত্যন্ত উন্নত সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেছেন, যেখানে গ্যালিয়াম আর্সেনাইডের সাহায্যে লেজারের আলো ধরে রাখা হয়। এর মধ্যে আলো ও পদার্থের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে এই পোলারিটন সুপারসলিড তৈরি করা হয়েছে।  

বর্তমানে বিজ্ঞানীরা পোলারিটনের মাধ্যমে আরও উন্নত অপটিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস তৈরির সম্ভাবনা খুঁজছেন।‌ তবে এই গবেষণার  সুদূরপ্রসারী‌ তাৎপর্য রয়েছে। পদার্থবিজ্ঞানে সুপারসলিড গবেষণা এক নতুন জ্ঞানের দুয়ার খুলে দিতে পারে এবং ভবিষ্যতের বিভিন্ন প্রযুক্তি উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর ক্ষেত্রে এটি বিপ্লব ঘটাতে পারে, কারণ সুপারসলিড উপাদান ব্যবহার করে অধিক কার্যকর ও শক্তিশালী কিউবিট তৈরি করা সম্ভব। সুপারকন্ডাক্টর বা ঘর্ষণহীন পরিবাহকের ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, যেটা বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ক্ষেত্রে এক বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে।
এছাড়াও, এই আবিষ্কার মহাবিশ্বের মৌলিক কাঠামো বুঝতেও আমাদের সাহায্য করতে পারে।

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জটিল নিয়ম অনুসারে, পদার্থ ও শক্তির সম্পর্ক কখনো কখনো আমাদের প্রচলিত ধারণার বাইরে চলে যায়। সুপারসলিডের গবেষণা সেই অজানা জগতের একটি জানালা খুলে দিয়েছে, যেখানে আলোর মতো এক অশরীরী সত্ত্বাকে কঠিনের বৈশিষ্ট্যে রূপান্তরিত করা সম্ভব হয়েছে।

এই গবেষণা কোয়ান্টাম প্রযুক্তি  উন্নয়নের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। আধুনিক বিজ্ঞান এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে বাস্তবতার সীমানা ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসছে। আমরা এখন এমন এক যুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে আলো, শক্তি ও পদার্থের মিশেলে নতুন নতুন উপাদানের সৃষ্টি সম্ভব হচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা এখন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে এই নতুন ধরনের সুপারসলিডের ব্যবহারিক দিকগুলো ভালোভাবে বোঝা যায় এবং ভবিষ্যতে এটি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন বিপ্লব ঘটাতে পারে। 

তথ্যসূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট।

Comments