মনে করুন, আপনি একটি বিশাল জংগলের মধ্যে রাতের বেলা হারিয়ে গেছেন। এখন আপনাকে এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজতে হবে। যদি আপনার কাছে একটা সাধারণ টর্চলাইট থাকে, তাহলে আপনাকে একটার পর একটা পথ ধরে এগোতে হবে। সঠিক রাস্তা খুঁজে পেতে অনেক সময় লেগে যাবে। কিন্তু যদি আপনার কাছে এমন এক জাদুর আলো থাকে, যা মুহূর্তেই পুরো জঙ্গলে আলো ছড়িয়ে দিয়ে সঠিক পথ দেখিয়ে দেয়, তাহলে আপনি খুব সহজেই গন্তব্য খুঁজে পাবেন।
ঠিক এমনি ভাবেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার কাজ করে। যেখানে সাধারণ কম্পিউটার একবারে শুধু একটা করে সম্ভাবনা পরীক্ষা করে, সেখানে কোয়ান্টাম কম্পিউটার সবগুলো সম্ভাবনাকে একসঙ্গে বিশ্লেষণ করতে পারে। ফলে এটি জটিল সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে পারে চোখের পলকেই। এটি কোনো ভবিষ্যতের প্রযুক্তি নয়, বরং বাস্তবতা, যা অদূর ভবিষ্যতে আমাদের জীবনযাত্রা বদলে দিবে।
সাধারণ কম্পিউটার তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করে বিট ব্যবহার করে, যা হয় ০ বা ১, এই দুই অবস্থায় থাকতে পারে। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার চলে কিউবিট দিয়ে, যা একই সঙ্গে ০ এবং ১ উভয় অবস্থায় থাকতে পারে। এই কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্যকে বলা হয়, সুপারপজিশন। এর ফলে কোয়ান্টাম কম্পিউটার একাধিক গাণিতিক বিশ্লেষণ একসঙ্গে চালাতে পারে। অন্যদিকে প্রচলিত কম্পিউটারকে একটির পর একটি বিশ্লেষণ আলাদা ভাবে করতে হয়।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এন্টেঙ্গেলমেন্ট, যেখানে দুটি কিউবিট একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত থাকে। যদি একটি কিউবিটের অবস্থা পরিবর্তন করা হয়, তাহলে অন্যটিও তাৎক্ষণিক ভাবে পরিবর্তিত হয়। এমনকি দু'টি কিউবিট একে অপরের থেকে বহুদূরে থাকলেও তারা পরস্পরের সাথে সংযুক্ত থাকে। এর মাধ্যমে কোয়ান্টাম কম্পিউটার তথ্য প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করতে পারে।
অদূর ভবিষ্যতে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রযুক্তির বড় প্রভাব পড়তে চলেছে আমাদের বাস্তব জীবনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে। এ নিয়ে সংক্ষেপে একটু আলোচনা করছি।
আজকের দিনে নতুন ওষুধ তৈরি করতে বিজ্ঞানীদের বিশাল পরিমাণ ডেটা এনালাইসিস করতে হয়। যেখানে প্রচলিত সুপার কম্পিউটারও অনেক সময় ধীরগতির হয়ে পড়ে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার জটিল প্রোটিন ফোল্ডিং প্রক্রিয়া খুব সহজেই বিশ্লেষণ করতে পারে। এটা ক্যান্সার, আলঝেইমার্স এবং কোভিড-১৯-এর মতো জটিল রোগের চিকিৎসায় এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গুগলের কোয়ান্টাম কম্পিউটার "সাইকামোর" ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা রাসায়নিক বিক্রিয়ার অণুগুলোর আচরণের পূর্বাভাস দেওয়ার চেষ্টা করছেন, যা ওষুধ শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে।
বিশ্বব্যাপী ব্যাংকিং এবং বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়। কোয়ান্টাম কম্পিউটার অতি দ্রুত ট্রেডিং অ্যালগরিদম তৈরি করতে পারে, যা এক মুহূর্তের মধ্যে স্টক মার্কেটের ওঠানামা বিশ্লেষণ করতে পারবে। মরগ্যান স্ট্যানলি এবং জেপি মরগ্যানের মত বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার করে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার কৌশল উন্নত করার চেষ্টা করছে।
আজকের দিনে আমাদের অনলাইন নিরাপত্তা বা সাইবার সিকিউরিটি নির্ভর করে এনক্রিপশনের ওপর। এগুলো বড় বড় সংখ্যার গুণ-ভাগ করার জটিলতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। প্রচলিত কম্পিউটারের পক্ষে এই এনক্রিপশন ভাঙতে প্রচুর সময় লাগে। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার, বিশেষ করে শোর'স অ্যালগরিদম ব্যবহার করে, এটি খুব দ্রুত ভেঙে ফেলতে পারে। ফলে ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম-প্রুফ এনক্রিপশন তৈরি করা হবে, যা আরও নিরাপদ হবে এবং হ্যাকিং প্রতিরোধ করবে। এর মাধ্যমে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক তৈরি হবে।
বিশ্বের জলবায়ু মডেলিং অত্যন্ত জটিল এবং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রচলিত কম্পিউটারের গতি এতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার জলবায়ুর পরিবর্তনের নিখুঁত পূর্বাভাস দিতে সক্ষম। এর ফলে কৃষি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কোয়ান্টাম কম্পিউটার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বড় বড় ডেটাসেট বিশ্লেষণ এবং প্যাটার্ন শনাক্তকরণে কোয়ান্টাম কম্পিউটার অনন্য। এটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI এর ক্ষেত্রে এক বিপ্লব আনতে পারে। মুখ চিনতে পারার সফটওয়্যার, ভাষা অনুবাদ, এবং স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সিস্টেমের দক্ষতা আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার।
এখানে বলে রাখি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এর বেশ কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কিউবিট অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং সামান্য তাপমাত্রা পরিবর্তনের কারণে এর স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এই সমস্যা ডিকোহেরেন্স নামে পরিচিত। এজন্য কোয়ান্টাম কম্পিউটার পরিচালনার জন্য বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ প্রয়োজন, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।অন্যদিকে, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জন্য নতুন ধরনের সফটওয়্যার এবং অ্যালগরিদম দরকার। প্রচলিত কম্পিউটারের প্রোগ্রামিং ভাষা এখানে কাজ করে না, তাই নতুন করে সফটওয়্যার ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে হবে।
তবে বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যেই এইসব সমস্যা সমাধানে কাজ করছেন।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। মাইক্রোসফট তাদের নতুন টোপোকন্ডাক্টর চিপের মাধ্যমে কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির সময়সীমা দশক থেকে কয়েক বছরে নামিয়ে আনার দাবি করেছে। জাপানে চালু হয়েছে বিশ্বের প্রথম হাইব্রিড কোয়ান্টাম সুপারকম্পিউটার 'রেইমেই', যা ২০-কিউবিটের ক্ষমতাসম্পন্ন এবং পৃথিবীর ষষ্ঠ দ্রুততম সুপারকম্পিউটার 'ফুগাকু'র সঙ্গে সংযুক্ত। এছাড়া, গুগল দাবি করেছে, তাদের নতুন কোয়ান্টাম কম্পিউটার মাত্র পাঁচ মিনিটে এমন কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে, যা সুপার কম্পিউটারের কোটি কোটি বছর লাগত। এগুলি প্রমাণ করে যে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। আশা করা যায়, খুব শিগগিরই এটি ব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
হয়তো একদিন আপনার হাতের স্মার্টফোনে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ক্ষমতা থাকবে। সুপার ইন্টেলিজেন্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আপনার দৈনন্দিন কাজ আরও সহজ করে তুলবে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ১০ -১৫ বছরের মধ্যেই এই প্রযুক্তি আমাদের জীবনযাত্রা, বিজ্ঞান গবেষণা, এবং শিল্প-ব্যবসার প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। এটি কেবল দ্রুত কম্পিউটিং নয়, বরং মানব সভ্যতার চিন্তাধারা পাল্টে দেওয়ার মতো একটি অনন্য আবিষ্কার হতে যাচ্ছে।
Comments