আজ বরেণ্য বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের জন্মদিন। ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি তিনি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় অসাধারণ মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন স্টিফেন হকিং। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার যোগ্যতা অর্জন করেন। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, অংক শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করবেন। কিন্তু পরে পদার্থবিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং এই বিষয়েই তাঁর ব্যাচেলর ডিগ্রী শেষ করেন। তারপর ১৯৬২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত গণিত এবং তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি গবেষণার কাজ শুরু করেন। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু ছিলো কসমোলজি এবং জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি। পিএইচডি গবেষণার কাজ শেষ করেন ১৯৬৬ সালে।
পিএইচডি গবেষণাকালীন সময়ে স্টিফেন হকিং একটি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। এ রোগের নাম, মোটর নিউরন ডিজিজ। এর ফলে ধীরে ধীরে তিনি চলাফেরার ক্ষমতা হারাতে থাকেন এবং একসময় সম্পূর্ণভাবে চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়েন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁর গবেষণার কাজ থেমে থাকেনি। অদম্য মনোবল নিয়ে তিনি গবেষণার কাজ অব্যাহত রাখেন। শারীরিক শক্তি হারালেও মনের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন সতেজ এবং সজীব। তাঁর চিন্তাশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর।
১৯৭৪ সালে তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটি করেন। ব্যাপক গবেষণা করে তিনি তাত্ত্বিকভাবে দেখিয়েছিলেন, ব্ল্যাক হোলের ইভেন্ট হরাইজনের সীমানায় এক ধরনের বিকিরণ হয়। কোয়ান্টাম শূন্যতার মাঝে যেসব ভার্চুয়াল কণা এবং প্রতিকণার উদ্ভব হয় তারই কিছুটা ইভেন্ট হরাইজনের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। এই কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের ফলে ব্ল্যাকহোল ধীরে ধীরে তার ভর হারায়। অত্যন্ত কম তাপমাত্রার এই বিকিরণকে বলা হয়, হকিং রেডিয়েশন। এর আগে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল ব্ল্যাকহোলের ভেতর থেকে কোন ধরনের বিকিরণই সম্ভব নয়। হকিংয়ের এই আবিষ্কারটি ব্ল্যাকহোল সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের পুরানো ধারনা একেবারেই পাল্টে দেয়। কর্মজীবনে হকিং ছিলেন, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ লুকাসিয়ান প্রফেসর অফ ম্যাথামেটিকস। একসময় স্যার আইজ্যাক নিউটন এই পদটি অলংকৃত করেছিলেন।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে স্টিফেন হকিং গুরুতর নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর ফলে তিনি স্বাভাবিকভাবে কথা বলার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু তিনি দমে যাননি। কম্পিউটারের মাধ্যমে বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে কথা বলা রপ্ত করেন। আশির দশকেই তাঁর লেখা জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই, "এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম" প্রকাশিত হয়। মহাবিশ্বের উৎপত্তি, বিকাশ এবং সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে খুব সহজবোধ্য ভাষায় সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তিনি লিখেছিলেন। স্টিফেন হকিং মনে করতেন, বিজ্ঞানের এসব কঠিন বিষয়গুলো সাধারণ মানুষেরও জানা প্রয়োজন। হকিং বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞানে সাধারণ মানুষেরও অধিকার রয়েছে। তাঁর লেখা এই বইটি মানুষ লুফে নিয়েছিলো। প্রকাশের পর ২৫ মিলিয়ন কপির বেশি বিক্রি হয়েছে বইটি। ডজনখানেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বহুবছর বেস্ট সেলারের তালিকায় ছিল বইটি। এই অনন্য সাধারণ বইটির জন্যই স্টিফেন হকিং সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন। এছাড়া, তিনি "দি গ্র্যান্ড ডিজাইন", "ব্ল্যাকহোল এন্ড বেবি ইউনিভার্স" সহ আরও বেশ কিছু বই লিখেছেন। তিনি তাঁর লেখা বইগুলোতে বিজ্ঞানের জটিল ধারণাগুলিকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজভাবে তুলে ধরেছেন। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আইনস্টাইনের পর তিনিই একমাত্র বিজ্ঞানী যিনি জনমানুষের কাছে একজন সেলিব্রেটির মর্যাদা পেয়েছিলেন।
মহাবিশ্বের সূচনা নিয়ে স্টিফেন হকিং প্রচুর তাত্ত্বিক গবেষণা করেছিলেন। এর মধ্যে কিছু গবেষণা ছিল রজার পেনরোজের সাথে যৌথভাবে। তাঁরা গাণিতিক ভাবে দেখান, একক একটি বিন্দু বা সিঙ্গুলারিটি থেকে সমগ্র মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে। এই একক বিন্দুর অতীতে আর কিছুই ছিল না। মহাবিশ্বে স্থান, কাল এবং বস্তুর সূচনা হয়েছে এই একক বিন্দু থেকে। একে বলে, "পেনরোজ-হকিং সিঙ্গুলারিটি থিওরেম"। তাঁদের এই তত্ত্ব ‘বিগ ব্যাং’ তত্ত্বের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের জন্ম ও বিকাশের একটি তাত্ত্বিক ধারণা পাওয়া যায়।
এখানে বলে রাখি, রজার পেনরোজকে ২০২০ সালে ব্ল্যাকহোল সংক্রান্ত গবেষণার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। অনেকে মনে করেন, বেঁচে থাকলে স্টিফেন হকিংকেও হয়তো একই সাথে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হতো।
নোবেল পুরস্কার না পেলেও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে স্টিফেন হকিংয়ের অবদান ছিল অসামান্য। বিজ্ঞান গবেষণার পাশাপাশি বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্য অক্লান্ত ভাবে তিনি কাজ করে গেছেন। বিজ্ঞানের কঠিন বিষয়গুলোকে সহজ করে তুলে ধরেছেন সাধারণ মানুষের কাছে। শারীরিক প্রতিবন্ধিতা তাঁর অসাধারণ মেধাকে কখনোই পরাস্ত করতে পারেনি। তিনি ছিলেন বর্তমান যুগের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গবেষক। তিনি তাঁর মৌলিক কাজের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে মহাবিশ্বের অসীম রহস্যের দিকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শিখিয়েছেন।
স্টিফেন হকিং শুধু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক মহাকাব্যিক চরিত্র ছিলেন না, তিনি বিশ্বের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও সামাজিক সমস্যায় তাঁর চিন্তাধারা এবং মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি প্রতিবন্ধীদের অধিকারের পক্ষে ছিলেন এবং বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সমর্থন কামনা করেছিলেন। তিনি বলেছেন, “আমাদের উচিত একে অপরের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রদর্শন করা এবং বৃহত্তর মহাবিশ্বের দিকে নজর দেওয়া।”
২০১৮ সালের ১৪ মার্চ ছিয়াত্তুর বছর বয়সে এই ক্ষণজন্মা বিজ্ঞানীর জীবনাবসান হয়। আজ জন্মদিনে তাঁর প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
Comments