মহাকাশ অভিযানের ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি

মানুষের মহাকাশ ভ্রমণের স্বপ্ন ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। কিন্তু এতে এখনও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। প্রচলিত রকেট প্রযুক্তি আমাদের মহাকাশে পাঠাচ্ছে ঠিকই, তবে এই রকেটগুলোর বড় সমস্যা হলো বিশাল জ্বালানি খরচ, দীর্ঘ যাত্রা সময় এবং সার্বিক নিরাপত্তার ঝুঁকি। বিশেষ করে মঙ্গল ও তার চেয়েও দূরবর্তী গ্রহে দ্রুত পৌঁছে যাওয়ার জন্য আমাদের আরও উন্নত প্রযুক্তির মহাকাশযান প্রয়োজন। এই সমস্যাগুলোর সমাধান হিসেবে বিজ্ঞানীরা প্রধানত দুটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির উপর বর্তমানে কাজ করছেন। এর একটি হলো প্লাজমা রকেট ইঞ্জিন আর অন্যটি হলো ক্যাটাপল্ট উৎক্ষেপণ সিস্টেম। আসুন এই নতুন দুটো প্রযুক্তি  সম্বন্ধে একটু জেনে নেই।

১. প্লাজমা রকেট ইঞ্জিন : বিদ্যুতের শক্তিতে মহাকাশ ভ্রমণ

প্লাজমা রকেট ইঞ্জিনকে অনেকেই ভবিষ্যতের রকেট প্রযুক্তি বলে মনে করেন। এটি এক ধরনের বৈদ্যুতিক রকেট, যা রাসায়নিক জ্বালানির পরিবর্তে প্লাজমা ব্যবহার করে শক্তি উৎপন্ন করে। প্লাজমা হচ্ছে এক ধরনের অতি উত্তপ্ত গ্যাস, যার মধ্যে বৈদ্যুতিক আয়ন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে। এই প্লাজমাকে চৌম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে তীব্র গতিতে পেছনে ছুঁড়ে দেওয়া হয়, যার ফলে সামনের দিকে রকেটের গতি ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।

এই প্রযুক্তির সবচেয়ে উন্নত সংস্করণ হলো ভ্যাসিমার (VASIMR - Variable Specific Impulse Magnetoplasma Rocket), বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে অ্যাড এসট্রা রকেট কোম্পানি এই ইঞ্জিন তৈরি করছে। তবে জানা গেছে, এ ব্যাপারে রাশিয়ানরাও পিছিয়ে নেই। তারাও প্লাজমা রকেট ইঞ্জিন নিয়ে গবেষণা অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। সম্প্রতি (ফেব্রুয়ারি, ২০২৫) রাশিয়ার রোসাটমের বিজ্ঞানীরা একটি প্রোটোটাইপ প্লাজমা রকেট ইঞ্জিনের সফল পরীক্ষা করেছেন।

প্লাজমা রকেট ইঞ্জিনে প্রথমে একটি গ্যাসকে (যেমন আর্গন বা জেনন) উচ্চ-তাপমাত্রার রেডিও তরঙ্গ দিয়ে উত্তপ্ত করে প্লাজমাতে পরিণত করা হয়। তারপর চৌম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে এই প্লাজমাকে এক্সহস্ট দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। তখন এটা রকেটকে সামনে চলার জন্য ক্রমাগত থ্রাস্ট দেয়। সাধারণ রাসায়নিক রকেট যেখানে অল্প সময়ের জন্য প্রচণ্ড শক্তি দেয়, প্লাজমা ইঞ্জিন সেখানে কম শক্তিতে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে পারে। ফলে এটি দীর্ঘ যাত্রার মহাকাশ অভিযানের জন্য অনেক বেশি কার্যকর।

প্লাজমা রকেট ইঞ্জিনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি খুবই জ্বালানি-সাশ্রয়ী। এটি ব্যবহার করলে মহাকাশযানের গতি দীর্ঘ সময় ধরে বাড়ানো সম্ভব। যেখানে রাসায়নিক জ্বালানির রকেট দিয়ে মঙ্গলে যেতে ৬ থেকে ৯ মাস সময় লাগে, সেখানে প্লাজমা রকেট ব্যবহার করে মাত্র একমাসেই সেখানে পৌঁছে যাওয়া যাবে।

দীর্ঘ মহাকাশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে সময় কমে গেলে মহাকাশচারীরা কম বিকিরণের শিকার হবেন এবং এতে তাদের শারীরিক ক্ষতিও কম হবে। এছাড়া জ্বালানি কম লাগার ফলে রকেটের ওজন কমে যাবে, যা উৎক্ষেপণ ব্যয় কমানোর পাশাপাশি মহাকাশে আরও বেশি মালামাল ও সরঞ্জাম বহন করার সুযোগ তৈরি করবে।

তবে এই প্রযুক্তির কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। প্লাজমা রকেট ইঞ্জিন চালানোর জন্য অনেক বেশি বিদ্যুৎ প্রয়োজন। মহাকাশে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পারমাণবিক চুল্লি দরকার হবে, যা এখনও চূড়ান্তভাবে কার্যকর করা হয়নি। এছাড়া প্লাজমা রকেট ইঞ্জিনের থ্রাস্ট বা শক্তি তুলনামূলক কম, তাই এটি পৃথিবী থেকে সরাসরি উৎক্ষেপণের জন্য ব্যবহার করা সম্ভব নয়। রকেটটিকে প্রথমে রাসায়নিক জ্বালানি দিয়ে মহাকাশে পাঠাতে হবে, তারপর প্লাজমা ইঞ্জিন চালু করা যাবে।

২. ক্যাটাপল্ট রকেট: নতুন প্রজন্মের উৎক্ষেপণ প্রযুক্তি

ক্যাটাপল্ট রকেট একেবারে ভিন্নধর্মী একটি প্রযুক্তি, যা মহাকাশযানকে উচ্চ গতিতে ছুঁড়ে দেওয়ার জন্য বাহ্যিক শক্তি ব্যবহার করে। এটি রকেটের প্রথম ধাপে প্রচলিত রাসায়নিক জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তি হলো ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ক্যাটাপল্ট এবং
স্পিন লঞ্চ সিস্টেম। 
 
ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ক্যাটাপল্ট প্রযুক্তিতে মহাকাশযানকে একটি বিশাল ম্যাগনেটিক ট্র্যাকের উপর রাখা হবে, তারপর অত্যন্ত শক্তিশালী ম্যাগনেটিক ফোর্স দিয়ে এটিকে প্রতি ঘন্টায় কয়েক হাজার কিলোমিটার গতিতে মহাকাশে ছুঁড়ে দেওয়া হবে। 

অন্যদিকে, স্পিনলঞ্চ পদ্ধতিতে, একটি স্পিনিং চেম্বারের ভেতরে মহাকাশযানকে রাখা হবে এবং তীব্র গতিতে ঘোরানোর পর হঠাৎ একে মুক্ত করে দেওয়া হবে, ফলে এটি  মহাকাশের দিকে অতি দ্রুত ছুটতে থাকবে। বর্তমানে এসব প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে।

এসব প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এতে জ্বালানির খরচ অনেক কম হবে। প্রচলিত রকেট উৎক্ষেপণে বিশাল পরিমাণ রাসায়নিক জ্বালানি পোড়ানো হয়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এবং ব্যয়সাপেক্ষ। ক্যাটাপল্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করলে উৎক্ষেপণের সময় রাসায়নিক জ্বালানির প্রয়োজন হবে না, বরং এটি মহাকাশে পৌঁছানোর পর ছোট রকেট ইঞ্জিন চালিয়ে গন্তব্যে যাত্রা করতে পারবে।

আরেকটি বড় সুবিধা হলো এটি পুনঃব্যবহারযোগ্য, অর্থাৎ একবার ক্যাটাপল্ট ব্যবস্থা বানানো হলে সেটি বারবার ব্যবহার করা যাবে। ফলে ভবিষ্যতে মহাকাশে পণ্য পাঠানো, কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপন এবং চাঁদ বা মঙ্গল থেকে মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করা অনেক সহজ হয়ে যাবে।

তবে এই প্রযুক্তির কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। ক্যাটাপল্ট রকেট উৎক্ষেপণের সময় অত্যন্ত বেশি জি-ফোর্স তৈরি হয়, যা মানুষের শরীরের জন্য সহনশীল নাও হতে পারে। তাই এটি মানুষের জন্য নিরাপদ করতে আরও গবেষণা প্রয়োজন। এছাড়া পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণজনিত কারণে উচ্চগতির উৎক্ষেপণ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। ফলে এটি চাঁদ বা মঙ্গলের মতো বায়ুমণ্ডলহীন অথবা হালকা বায়ুমণ্ডলে বেশি কার্যকর হতে পারে।

এই দুটি প্রযুক্তি একসঙ্গে কাজ করলে মহাকাশ ভ্রমণ অনেক সহজ ও সাশ্রয়ী হয়ে উঠবে। প্লাজমা রকেট ইঞ্জিন ব্যবহারের ফলে মহাকাশযানের জ্বালানি খরচ কমে যাবে, আর যাত্রার সময়ও অনেক কমে যাবে। অন্যদিকে, ক্যাটাপল্ট উৎক্ষেপণ ব্যবস্থার ফলে মহাকাশে পে-লোড পাঠানোর খরচ কমে যাবে, যা মহাকাশ গবেষণা ও অন্য গ্রহে মানব বসতি স্থাপনে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। মহাকাশ বিজয়ের পথে প্লাজমা রকেট ইঞ্জিন ও ক্যাটাপল্ট উৎক্ষেপণ প্রযুক্তি‌ অদূর ভবিষ্যতে মানুষকে এক নতুন দিগন্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। 

© তানভীর হোসেন

Comments