বিশাল মহাবিশ্ব

সাম্প্রতিক এক কসমোলজিক্যাল গবেষণায় বলা হয়েছে, আমাদের চেনা মহাবিশ্বে ২০০ বিলিয়ন থেকে ২ ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সি রয়েছে। আমরা জানি, এরই মাঝে একটি হলো আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি, যার ভেতর রয়েছে ১০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র সঠিক সংখ্যাটি অবশ্য নিশ্চিত করে কারো জানা নেই।

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মধ্যে একটি অতি সাধারণ ও মাঝারি মাপের নক্ষত্র হলো, আমাদের সূর্যি মামা। সূর্যের আটটি গ্রহের একটি হলো, আমাদের বাসভূমি পৃথিবী। ‌গ্রহটি সাইজে আহামরি বড় কিছু নয়। বলাই বাহুল্য, এই বিশাল মহাবিশ্বে আমাদের আবাসস্থল পৃথিবীর অবস্থান অতি নগণ্য ও অকিঞ্চিৎকর। অন্যদিকে দৃশ্যমান মহাবিশ্ব আমাদের কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি বিস্ময়কর ও বিশাল।

বিজ্ঞানীরা ব্যাপক গবেষণা করে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের একটি পরিমাপ বের করেছেন। তাঁদের গবেষণায় উঠে এসেছে, পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বে  সর্বোচ্চ ৪৬.৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের বিকিরণ সনাক্ত করা সম্ভব। ‌সেই অনুযায়ী বলা যায়, আমাদের চেনা মহাবিশ্বের ব্যাস, ৪৬.৫ + ৪৬.৫ = ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। অর্থাৎ মহাবিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আলো পৌঁছতে সময় লাগবে ৯৩ বিলিয়ন বছর। ভাবা যায়? এটা একটি অচিন্তনীয় দূরত্ব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মহাবিশ্বের এই বিশাল ব্যাপ্তি কিভাবে নির্ণয় করা হয়েছে ?

বিজ্ঞানীদের মতে, এখন থেকে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে একটি মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাংয়ের ফলে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল। এই বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট বিকিরণ মহাবিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। বর্তমান যুগে এসে মহাবিশ্বের এই প্রারম্ভিক বিকিরণের আভা,  কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (CMB) হিসেবে রেডিও টেলিস্কোপে ধরা পড়ে। ১৯৬৪ সালে দুজন মার্কিন রেডিও প্রকৌশলী আকস্মিকভাবেই তাঁদের স্থাপিত এন্টেনায় এই বিকিরণটি আবিষ্কার করেছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, আগেকার যুগে এনালগ টেলিভিশনে চ্যানেল না থাকলে যে ঝিরঝির ছবি এবং শিরশির শব্দ হতো, সেটার উৎসের কিছুটা হলো এই কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড।  এই হালকা মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ মহাবিশ্বের  সর্বত্র ছড়িয়ে আছে।

পৃথিবীর কক্ষপথে অবস্থিত নাসার WMAP এবং ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার Planck স্যাটেলাইট CMB বিকিরণের খুব সুক্ষ মানচিত্র তৈরি করেছে। এই CMB মানচিত্র বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা হিসেব করে বলেছেন, মহাবিশ্বের ব্যাস ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। এছাড়াও আরো বেশ কিছু পর্যবেক্ষণের ও পরীক্ষার মাধ্যমে  বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে, দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোর লোহিত সরণ বা রেড শিফট  পর্যবেক্ষণ, হাবল ধ্রুবক বা কনস্ট্যান্টের প্রয়োগ, এ ওয়ান সুপার নোভার উজ্জ্বলতা পরীক্ষা এবং মহাবিশ্বের প্রাথমিক তরঙ্গ (Baryon Acoustic Oscillations)
পর্যবেক্ষণ। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে বিস্তারিত এখানে লিখছি না।

কিন্তু এরপরও একটা প্রশ্ন থেকে যায়, মহাবিশ্ব যদি ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে সৃষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে তো মহাবিশ্বে সর্বোচ্চ ১৩.৮ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের বিকিরণ সনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু আগেই বলেছি, বিজ্ঞানীরা এর চেয়েও তিনগুণ বেশি দূরে, ৪৬.৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের CMB বিকিরণ সনাক্ত করেছেন। এটা কিভাবে সম্ভব? এটা তো, "বাবার চেয়ে ছেলের বয়স বেশি" হওয়ার মতো ব্যাপার হয়ে গেল। এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা অবশ্য ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

আমরা জানি, মহাবিশ্বে আলোর গতিই হলো বস্তুর সর্বোচ্চ গতিসীমা। এর চেয়ে বেশি গতিতে কোন বস্তু চলতে পারে না। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, আলোর গতির এই সর্বোচ্চ সীমাটি বস্তুর জন্য প্রযোজ্য হলেও, শূন্যস্থান বা স্পেসের জন্য প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ শূন্যস্থান আলোর গতির চেয়েও অনেক বেশি গতিতে প্রসারিত হতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বিগ ব্যাংয়ের অব্যাহতি পর পরই সেকেন্ডের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের মধ্যে এক অচিন্ত্যনীয় গতিতে স্পেসের প্রসারণ ঘটেছিল। এর নাম হলো, কসমিক ইনফ্লেশন। এটা ঘটেছিল, আলোর গতির চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতগতিতে।  প্রারম্ভিক মহাবিশ্ব আলোর চেয়েও অনেক অনেক দ্রুত গতিতে প্রসারিত হয়েছিল। এটা মহাবিশ্বের বিশালতার প্রাথমিক কারণ।

বর্তমানেও মহাবিশ্ব ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, গ্যালাক্সিগুলোর প্রসারনের মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যভাবে বলতে হয়, গ্যালাক্সিগুলো প্রকৃতপক্ষে স্থির রয়েছে, কিন্তু গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যবর্তী যে ফাঁকা অংশ রয়েছে সেটা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে,  কোন এক অদৃশ্য শক্তি গ্যালাক্সিগুলোকে দূর থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এই গুপ্ত শক্তির নাম দিয়েছেন ডার্ক এনার্জি। এই গুপ্ত শক্তির রহস্য বিজ্ঞানীরা এখনো বের করতে পারেননি। সেজন্যই হয়তো এর নামের শুরুতে ডার্ক তকমাটা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। মহাবিশ্বের বিশালতার পেছনে ডার্ক এনার্জির প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে।

রেড শিফটের পরিমাণ পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোর প্রসারণের গতি আমাদের নিকটবর্তী গ্যালাক্সির গুলোর চেয়ে অনেক বেশি। যে গ্যালাক্সি যত দূরে অবস্থিত তার প্রসারণের হারও তত বেশি। এর ফলে, মহাবিশ্বের ৯৪% গ্যালাক্সি  আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যাবে। অর্থাৎ আলোর গতিতে ছুটতে পারলেও আমরা কখনোই মহাবিশ্বের ৯৪ শতাংশ গ্যালাক্সির কাছে পৌঁছাতে পারবো না। মহাবিশ্বের অতি দ্রুত প্রসারণই এর কারণ। এর ফলে, ১৮ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সিগুলো চিরকালই আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাবে। বিজ্ঞানীদের হিসেবে, প্রতিবছর দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোর ১৬০ বিলিয়ন নক্ষত্র আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে, এক সময় আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কাছাকাছি যেসব লোকাল গ্যালাক্সি আছে, সেগুলো ছাড়া অন্য সব গ্যালাক্সি আমাদের দৃষ্টির বাইরে চলে যাবে।‌ বলাই বাহুল্য, পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের পরিধি তখন কমে যাবে।

তাহলে মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি কী হবে? এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা অবশ্য নানা মত দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, মহাবিশ্বের সম্ভাব্য তিনটি পরিণতি হতে পারে:

মহাবিশ্ব যদি ক্রমাগত প্রসারিত হতে থাকে তাহলে একসময় সমস্ত শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে মহাবিশ্ব স্থবির হয়ে পড়বে এবং এর তাপীয় মৃত্যু হবে। একে বলে হিট ডেথ।

অথবা, মহাবিশ্বের প্রসারণ যদি কোন কারণে থেমে যায় তাহলে মহাকর্ষের প্রভাবে মহাবিশ্ব সংকুচিত হাওয়া শুরু করবে এবং‌ এক সময় একটি বিন্দুতে এসে ধ্বসে পড়বে। এই তত্ত্বকে  বলে "বিগ ক্রাঞ্চ"। তবে বর্তমান পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, এটি হওয়ার সম্ভাবনা কম।

অথবা, যদি মহাবিশ্বের প্রসারণ ক্রমশ আরো ত্বরান্বিত হয়, তাহলে এক সময় মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তু একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এটিকে "বিগ রিপ" বলা হয়। এটা হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

মোদ্দা কথা হলো, পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব আমাদের জন্য একটি বিশাল রহস্যের ভান্ডার। এর ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ আকার, ১৩.৮ বিলিয়ন বছরের বয়স, এবং ২ ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সির উপস্থিতি আমাদের কল্পনাকে ছাড়িয়ে যায়। মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি এখনও অজানা, তবে এর প্রতিটি ধাপ আমাদের বিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচনে সহায়তা করছে। মহাবিশ্বকে বুঝতে চাইলে আমাদের আরও গবেষণা এবং নতুন আবিষ্কারের জন্য  অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে।

© তানভীর হোসেন

Comments