মার্কিন ঔপন্যাসিক ড্যান ব্রাউনের লেখা একটি জনপ্রিয় রহস্য উপন্যাসের নাম হলো "এঞ্জেলস এন্ড ডিমন্স" (Angels and Demons)। উপন্যাসটির কাহিনী নিয়ে একই নামে একটি ব্লকবাস্টার সিনেমাও তৈরি হয়েছে। সিনেমার শুরুতে দেখা যায়, সার্নের (CERN) একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীর হাতে খুন হয়েছেন। এখানে বলে রাখি, সার্ন হলো ইউরোপিয়ান নিউক্লিয়ার রিসার্চ অর্গানাইজেশনের সংক্ষিপ্ত নাম। জেনিভার কাছে সুইজারল্যান্ড এবং ফ্রান্সের সীমান্তে এর অবস্থান। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পার্টিকেল এক্সেলেটর, লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (LHC) এখানেই অবস্থিত।
বিজ্ঞানীকে হত্যা করে গল্পের সেই সন্ত্রাসী সার্নের ল্যাবরেটরি থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে অতি গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টি-ম্যাটার। বাংলায় যাকে বলে প্রতি-পদার্থ। অ্যান্টি-ম্যাটার শুধু অতি গুরুত্বপূর্ণই নয়, এটি অত্যন্ত ভয়ঙ্করও বটে। প্রতি-পদার্থ যদি সাধারণ পদার্থের সংস্পর্শে আসে তাহলে উভয় পদার্থই ভয়াবহ শক্তি বিকিরণ করে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সেজন্য প্রতি-পদার্থ দিয়ে পারমাণবিক বোমার মত ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটানো সম্ভব। এ রকম ভয়ঙ্কর বস্তু সন্ত্রাসীর হাতে চলে যাওয়াটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। এ নিয়েই গল্পের সাসপেন্স শুরু। এরপর সেই সন্ত্রাসী অ্যান্টি-ম্যাটার দিয়ে রোমের ভ্যাটিকান সিটি উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করলো। ভয়াবহ অবস্থা। শুরু হলো গল্পের নায়ক এবং সন্ত্রাসীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। টানটান উত্তেজনাপূর্ণ ছবিটি আমার কাছে ভালোই লেগেছে। তবে গল্পটি আমি আর বেশি বলবো না। আগেভাগেই বলে দিলে কাহিনীর মজা থাকবে না।
অ্যান্টি-ম্যাটার বা প্রতি-পদার্থ কোন কাল্পনিক বস্তু নয়। এটি একেবারে পরীক্ষিত সত্য। আমরা জানি সাধারণ পদার্থ তৈরি হয় কিছু মৌলিক বস্তুকণা দিয়ে। এসব বস্তুকণার বিপরীত বস্তুকণা দিয়ে তৈরি হয় প্রতি-পদার্থ। সাধারণ বস্তুকণার বিপরীত বস্তুকণাকে বলে প্রতি-কণা, ইংরেজিতে বলে অ্যান্টি পার্টিক্যাল। এসব প্রতি-কণার ভর সাধারণ বস্তুকণার সমান হলেও এদের ধর্ম হলো সম্পূর্ণ বিপরীত।
প্রতি-কণার প্রাথমিক ধারণাটি দিয়েছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানী পল ডিরাক। তিনি ছিলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একজন অন্যতম দিকপাল। ইলেকট্রনের গতি প্রকৃতির ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছিলেন তাঁর বিখ্যাত ডিরাক সমীকরণের মাধ্যমে। ডিরাক তাত্ত্বিকভাবে দেখিয়েছিলেন ইলেকট্রনের বিপরীতে অ্যান্টি-ইলেকট্রনের অস্তিত্বও থাকা সম্ভব। ১৯৩২ সালে, কার্ল অ্যান্ডারসন নামে একজন পদার্থ বিজ্ঞানী মহাজাগতিক কসমিক রশ্মির মধ্যে সত্যি সত্যিই অ্যান্টি-ইলেকট্রনের সন্ধান পেলেন। এর নাম দেয়া হলো পজিট্রন। এর ভর ইলেকট্রনের সমান হলেও চার্জ হলো বিপরীত, অর্থাৎ পজিটিভ। পজিট্রন হলো পজেটিভ ইলেকট্রন। এই আবিষ্কারটির জন্য কার্ল অ্যান্ডারসনকে ১৯৩৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিলো।
১৯৫৫ সালে প্রোটনের বিপরীতে অ্যান্টি-প্রোটনের সন্ধান পেয়েছিলেন এমিলিও সার্গেই এবং ওয়েন চেম্বারলিন নামে দুইজন পদার্থ বিজ্ঞানী। এই আবিষ্কারের জন্য ১৯৫৯ তাঁরা দুজনেই পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এদিকে ১৯৫৬ সালেই নিউট্রনের বিপরীতে অ্যান্টি-নিউট্রনের সন্ধান পেয়েছিলেন ব্রুস কর্ক নামে আরেকজন পদার্থ বিজ্ঞানী। তাঁকে অবশ্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি।যদিও তাঁর আবিষ্কারটিও ছিলো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এভাবেই গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রনের বিপরীতে তিনটি সংশ্লিষ্ট প্রতি-কণা আবিষ্কৃত হয়েছিলো।
পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, পরমাণুর কেন্দ্রের প্রোটন এবং নিউট্রনের ভেতরে আরও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণার অস্তিত্ব রয়েছে। এদের নাম হলো কোয়ার্ক।
কোয়ার্ক রয়েছে মোট ছয়টি, এদের তিনটি জোড়া: আপ কোয়ার্ক এবং ডাউন কোয়ার্ক ; চার্ম কোয়ার্ক এবং স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক ; টপ কোয়ার্ক এবং বটম কোয়ার্ক। এই ছয়টি কোয়ার্কের বিপরীতে ছয়টি অ্যান্টি কোয়ার্কের সন্ধানও পাওয়া গেছে।
ইলেকট্রন অথবা ইলেকট্রন জাতীয় বস্তুকণাকে বলে লেপ্টন। কোয়ার্কের মত লেপ্টনও রয়েছে ছয়টি। এরাও তিনটি জোড়ায় বিভক্ত। এরা হলো, ইলেকট্রন এবং ইলেকট্রন নিউট্রিনো; মিউওন এবং মিউওন নিউট্রিনো; টাও এবং টাও নিউট্রিনো। এদের বিপরীতেও ছয়টি অ্যান্টি লেপ্টনের সন্ধান পাওয়া গেছে। মোদ্দা কথা হলো, বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি মৌলিক বস্তুকণার বিপরীতেই সংশ্লিষ্ট প্রতি-কণার সন্ধান পেয়েছেন।
এসব প্রতি-কণা দিয়ে তৈরি হতে পারে প্রতি-পদার্থ বা অ্যান্টিম্যাটার। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো মহাবিশ্বে আমরা প্রতি-পদার্থ দেখতে পাই না। আমাদের চারপাশে শুধুমাত্র পদার্থই দৃশ্যমান হয়, প্রতি-পদার্থ নয়। কেবলমাত্র কিছু তেজস্ক্রিয় বিক্রিয়াতে অথবা উচ্চশক্তির পরমাণু বিধ্বংসী পরীক্ষায় খুবই ক্ষণস্থায়ী প্রতি-কণার সন্ধান মেলে। কিন্তু মহাবিশ্বের কোথাও স্থায়ী প্রতি-পদার্থের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সৃষ্টির আদিলগ্নে অতি উচ্চ তাপমাত্রায় যখন সাধারণ বস্তুকণাগুলো সৃষ্টি হয়েছিলো তখন তার বিপরীতে সমান সংখ্যক প্রতি-কণাও সৃষ্টি হয়েছিলো। আদি মহাবিশ্বে সাধারণ বস্তুকণা এবং প্রতি-কণাগুলোর মধ্যে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষও ঘটেছিলো। বিজ্ঞানীরা এটাও জানেন, বস্তুকণা যখন তার বিপরীত প্রতি-কণার সংস্পর্শে আসে তখন উভয় কণাই প্রচন্ড শক্তি বিকিরণ করে শূন্যে নিশ্চিহ্ন যায়। তাহলে মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর পরই বস্তুকণা এবং প্রতি-কণার মিথস্ক্রিয়ার ফলে সকল বস্তুকণাই নিশ্চিহ্ন হয়ে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে শুধুমাত্র প্রতি-কণাগুলো মহাবিশ্ব থেকে হারিয়ে গেছে। সাধারণ বস্তুকণাগুলো মহাবিশ্বে স্থায়িত্ব পেয়েছে। বিজ্ঞানীদের হিসেবে, মহাবিশ্বের সূচনায় প্রতি বিলিয়ন সাধারণ বস্তুকণার মধ্যে মাত্র একটি বস্তুকণা নিশ্চিহ্ন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। পরবর্তীতে এই সামান্য পরিমাণ বস্তুকণা দিয়েই মহাবিশ্বের যাবতীয় গ্যালাক্সিসহ গ্রহ-নক্ষত্র এবং যাবতীয় দৃশ্যমান পদার্থের সৃষ্টি হয়েছে।
মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর প্রতি-কণাগুলো কেন হারিয়ে গেল? এটি এখনো পদার্থ বিজ্ঞানের একটি বিশাল অমীমাংসিত প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি নিয়ে বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরেই গবেষণা করছেন। কিন্তু এখনো নিশ্চিতভাবে এর উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন ধরনের কোয়ার্ক এবং অ্যান্টি কোয়ার্কের ক্ষয় নিয়ে নিবিড় পরীক্ষার ফলে বিজ্ঞানীদের কাছে মনে হয়েছে, পরমাণুর কেন্দ্রের উইক নিউক্লিয়ার ফোর্সই হয়তো এর জন্য দায়ী। তাদের ধারণা, উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স প্রতি-পদার্থের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভাবে কাজ করে। সেজন্য প্রাকৃতিক ভাবেই প্রতি-পদার্থ সাধারণ পদার্থের চেয়ে বেশি গতিতে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু এই ধারণার স্বপক্ষে বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো যথেষ্ট পরীক্ষামূলক প্রমাণ নেই। কিছু কিছু তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী অবশ্য মনে করেন, বস্তুকণার স্ট্যান্ডার্ড মডেলে বর্ণিত তিনটি প্রাকৃতিক বলকে একত্রিত করে একটি সমন্বিত বলে রূপান্তরিত করতে পারলেই মহাবিশ্ব থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রতি-পদার্থের সমস্যাটির সমাধান করা যাবে। এই লক্ষ্যেই সার্নের বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন।
আসলে "এঞ্জেলস এন্ড ডিমন্স" এর কাহিনীর মতো প্রতি-পদার্থ সার্ন থেকে থেকে হারিয়ে যায়নি। প্রতি-পদার্থ পুরো মহাবিশ্ব থেকেই হারিয়ে গেছে। সার্নের বিজ্ঞানীরা একে খুঁজে পাবার প্রচেষ্টায় সক্রিয় রয়েছেন। পরীক্ষামূলকভাবে তাঁরা অ্যান্টি প্রোটন এবং পজিট্রনের সমন্বয়ে অতি সামান্য পরিমাণ অ্যান্টি হাইড্রোজেন পরমাণু তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। অ্যান্টি ম্যাটারকে সংরক্ষণ করে রাখা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। কারণ সাধারণ পদার্থের সংস্পর্শে আসলে নিমেষের মধ্যে প্রতি-পদার্থ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। প্রতি-পদার্থকে এক বিশেষ ধরনের ম্যাগনেটিক ট্রাপের মধ্যে সংরক্ষণ করা হয়। একে বলা হয় পেনিং ট্রাপ। এর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রভাবে প্রতি-পদার্থ সাধারণ পদার্থের সংস্পর্শে আসতে পারে না। প্রতি-পদার্থ তৈরি করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বর্তমান প্রযুক্তিতে এক গ্রাম প্রতি-পদার্থ তৈরি করতে সম্ভাব্য খরচ হবে প্রায় তেষট্টি ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। সে হিসেবে প্রতিপদার্থ হলো বিশ্বের সবচাইতে মূল্যবান বস্তু।
সার্নের অ্যান্টি ম্যাটার গবেষণা সম্বন্ধে আরো তথ্য পাওয়া যাবে নিচের লিংকে
https://home.cern/science/physics/antimatter
বিজ্ঞানীকে হত্যা করে গল্পের সেই সন্ত্রাসী সার্নের ল্যাবরেটরি থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে অতি গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টি-ম্যাটার। বাংলায় যাকে বলে প্রতি-পদার্থ। অ্যান্টি-ম্যাটার শুধু অতি গুরুত্বপূর্ণই নয়, এটি অত্যন্ত ভয়ঙ্করও বটে। প্রতি-পদার্থ যদি সাধারণ পদার্থের সংস্পর্শে আসে তাহলে উভয় পদার্থই ভয়াবহ শক্তি বিকিরণ করে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সেজন্য প্রতি-পদার্থ দিয়ে পারমাণবিক বোমার মত ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটানো সম্ভব। এ রকম ভয়ঙ্কর বস্তু সন্ত্রাসীর হাতে চলে যাওয়াটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। এ নিয়েই গল্পের সাসপেন্স শুরু। এরপর সেই সন্ত্রাসী অ্যান্টি-ম্যাটার দিয়ে রোমের ভ্যাটিকান সিটি উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করলো। ভয়াবহ অবস্থা। শুরু হলো গল্পের নায়ক এবং সন্ত্রাসীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। টানটান উত্তেজনাপূর্ণ ছবিটি আমার কাছে ভালোই লেগেছে। তবে গল্পটি আমি আর বেশি বলবো না। আগেভাগেই বলে দিলে কাহিনীর মজা থাকবে না।
অ্যান্টি-ম্যাটার বা প্রতি-পদার্থ কোন কাল্পনিক বস্তু নয়। এটি একেবারে পরীক্ষিত সত্য। আমরা জানি সাধারণ পদার্থ তৈরি হয় কিছু মৌলিক বস্তুকণা দিয়ে। এসব বস্তুকণার বিপরীত বস্তুকণা দিয়ে তৈরি হয় প্রতি-পদার্থ। সাধারণ বস্তুকণার বিপরীত বস্তুকণাকে বলে প্রতি-কণা, ইংরেজিতে বলে অ্যান্টি পার্টিক্যাল। এসব প্রতি-কণার ভর সাধারণ বস্তুকণার সমান হলেও এদের ধর্ম হলো সম্পূর্ণ বিপরীত।
প্রতি-কণার প্রাথমিক ধারণাটি দিয়েছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানী পল ডিরাক। তিনি ছিলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একজন অন্যতম দিকপাল। ইলেকট্রনের গতি প্রকৃতির ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছিলেন তাঁর বিখ্যাত ডিরাক সমীকরণের মাধ্যমে। ডিরাক তাত্ত্বিকভাবে দেখিয়েছিলেন ইলেকট্রনের বিপরীতে অ্যান্টি-ইলেকট্রনের অস্তিত্বও থাকা সম্ভব। ১৯৩২ সালে, কার্ল অ্যান্ডারসন নামে একজন পদার্থ বিজ্ঞানী মহাজাগতিক কসমিক রশ্মির মধ্যে সত্যি সত্যিই অ্যান্টি-ইলেকট্রনের সন্ধান পেলেন। এর নাম দেয়া হলো পজিট্রন। এর ভর ইলেকট্রনের সমান হলেও চার্জ হলো বিপরীত, অর্থাৎ পজিটিভ। পজিট্রন হলো পজেটিভ ইলেকট্রন। এই আবিষ্কারটির জন্য কার্ল অ্যান্ডারসনকে ১৯৩৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিলো।
১৯৫৫ সালে প্রোটনের বিপরীতে অ্যান্টি-প্রোটনের সন্ধান পেয়েছিলেন এমিলিও সার্গেই এবং ওয়েন চেম্বারলিন নামে দুইজন পদার্থ বিজ্ঞানী। এই আবিষ্কারের জন্য ১৯৫৯ তাঁরা দুজনেই পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এদিকে ১৯৫৬ সালেই নিউট্রনের বিপরীতে অ্যান্টি-নিউট্রনের সন্ধান পেয়েছিলেন ব্রুস কর্ক নামে আরেকজন পদার্থ বিজ্ঞানী। তাঁকে অবশ্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি।যদিও তাঁর আবিষ্কারটিও ছিলো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এভাবেই গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রনের বিপরীতে তিনটি সংশ্লিষ্ট প্রতি-কণা আবিষ্কৃত হয়েছিলো।
পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, পরমাণুর কেন্দ্রের প্রোটন এবং নিউট্রনের ভেতরে আরও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণার অস্তিত্ব রয়েছে। এদের নাম হলো কোয়ার্ক।
কোয়ার্ক রয়েছে মোট ছয়টি, এদের তিনটি জোড়া: আপ কোয়ার্ক এবং ডাউন কোয়ার্ক ; চার্ম কোয়ার্ক এবং স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক ; টপ কোয়ার্ক এবং বটম কোয়ার্ক। এই ছয়টি কোয়ার্কের বিপরীতে ছয়টি অ্যান্টি কোয়ার্কের সন্ধানও পাওয়া গেছে।
ইলেকট্রন অথবা ইলেকট্রন জাতীয় বস্তুকণাকে বলে লেপ্টন। কোয়ার্কের মত লেপ্টনও রয়েছে ছয়টি। এরাও তিনটি জোড়ায় বিভক্ত। এরা হলো, ইলেকট্রন এবং ইলেকট্রন নিউট্রিনো; মিউওন এবং মিউওন নিউট্রিনো; টাও এবং টাও নিউট্রিনো। এদের বিপরীতেও ছয়টি অ্যান্টি লেপ্টনের সন্ধান পাওয়া গেছে। মোদ্দা কথা হলো, বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি মৌলিক বস্তুকণার বিপরীতেই সংশ্লিষ্ট প্রতি-কণার সন্ধান পেয়েছেন।
এসব প্রতি-কণা দিয়ে তৈরি হতে পারে প্রতি-পদার্থ বা অ্যান্টিম্যাটার। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো মহাবিশ্বে আমরা প্রতি-পদার্থ দেখতে পাই না। আমাদের চারপাশে শুধুমাত্র পদার্থই দৃশ্যমান হয়, প্রতি-পদার্থ নয়। কেবলমাত্র কিছু তেজস্ক্রিয় বিক্রিয়াতে অথবা উচ্চশক্তির পরমাণু বিধ্বংসী পরীক্ষায় খুবই ক্ষণস্থায়ী প্রতি-কণার সন্ধান মেলে। কিন্তু মহাবিশ্বের কোথাও স্থায়ী প্রতি-পদার্থের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সৃষ্টির আদিলগ্নে অতি উচ্চ তাপমাত্রায় যখন সাধারণ বস্তুকণাগুলো সৃষ্টি হয়েছিলো তখন তার বিপরীতে সমান সংখ্যক প্রতি-কণাও সৃষ্টি হয়েছিলো। আদি মহাবিশ্বে সাধারণ বস্তুকণা এবং প্রতি-কণাগুলোর মধ্যে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষও ঘটেছিলো। বিজ্ঞানীরা এটাও জানেন, বস্তুকণা যখন তার বিপরীত প্রতি-কণার সংস্পর্শে আসে তখন উভয় কণাই প্রচন্ড শক্তি বিকিরণ করে শূন্যে নিশ্চিহ্ন যায়। তাহলে মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর পরই বস্তুকণা এবং প্রতি-কণার মিথস্ক্রিয়ার ফলে সকল বস্তুকণাই নিশ্চিহ্ন হয়ে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে শুধুমাত্র প্রতি-কণাগুলো মহাবিশ্ব থেকে হারিয়ে গেছে। সাধারণ বস্তুকণাগুলো মহাবিশ্বে স্থায়িত্ব পেয়েছে। বিজ্ঞানীদের হিসেবে, মহাবিশ্বের সূচনায় প্রতি বিলিয়ন সাধারণ বস্তুকণার মধ্যে মাত্র একটি বস্তুকণা নিশ্চিহ্ন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। পরবর্তীতে এই সামান্য পরিমাণ বস্তুকণা দিয়েই মহাবিশ্বের যাবতীয় গ্যালাক্সিসহ গ্রহ-নক্ষত্র এবং যাবতীয় দৃশ্যমান পদার্থের সৃষ্টি হয়েছে।
মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর প্রতি-কণাগুলো কেন হারিয়ে গেল? এটি এখনো পদার্থ বিজ্ঞানের একটি বিশাল অমীমাংসিত প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি নিয়ে বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরেই গবেষণা করছেন। কিন্তু এখনো নিশ্চিতভাবে এর উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন ধরনের কোয়ার্ক এবং অ্যান্টি কোয়ার্কের ক্ষয় নিয়ে নিবিড় পরীক্ষার ফলে বিজ্ঞানীদের কাছে মনে হয়েছে, পরমাণুর কেন্দ্রের উইক নিউক্লিয়ার ফোর্সই হয়তো এর জন্য দায়ী। তাদের ধারণা, উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স প্রতি-পদার্থের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভাবে কাজ করে। সেজন্য প্রাকৃতিক ভাবেই প্রতি-পদার্থ সাধারণ পদার্থের চেয়ে বেশি গতিতে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু এই ধারণার স্বপক্ষে বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো যথেষ্ট পরীক্ষামূলক প্রমাণ নেই। কিছু কিছু তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী অবশ্য মনে করেন, বস্তুকণার স্ট্যান্ডার্ড মডেলে বর্ণিত তিনটি প্রাকৃতিক বলকে একত্রিত করে একটি সমন্বিত বলে রূপান্তরিত করতে পারলেই মহাবিশ্ব থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রতি-পদার্থের সমস্যাটির সমাধান করা যাবে। এই লক্ষ্যেই সার্নের বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন।
আসলে "এঞ্জেলস এন্ড ডিমন্স" এর কাহিনীর মতো প্রতি-পদার্থ সার্ন থেকে থেকে হারিয়ে যায়নি। প্রতি-পদার্থ পুরো মহাবিশ্ব থেকেই হারিয়ে গেছে। সার্নের বিজ্ঞানীরা একে খুঁজে পাবার প্রচেষ্টায় সক্রিয় রয়েছেন। পরীক্ষামূলকভাবে তাঁরা অ্যান্টি প্রোটন এবং পজিট্রনের সমন্বয়ে অতি সামান্য পরিমাণ অ্যান্টি হাইড্রোজেন পরমাণু তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। অ্যান্টি ম্যাটারকে সংরক্ষণ করে রাখা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। কারণ সাধারণ পদার্থের সংস্পর্শে আসলে নিমেষের মধ্যে প্রতি-পদার্থ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। প্রতি-পদার্থকে এক বিশেষ ধরনের ম্যাগনেটিক ট্রাপের মধ্যে সংরক্ষণ করা হয়। একে বলা হয় পেনিং ট্রাপ। এর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রভাবে প্রতি-পদার্থ সাধারণ পদার্থের সংস্পর্শে আসতে পারে না। প্রতি-পদার্থ তৈরি করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বর্তমান প্রযুক্তিতে এক গ্রাম প্রতি-পদার্থ তৈরি করতে সম্ভাব্য খরচ হবে প্রায় তেষট্টি ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। সে হিসেবে প্রতিপদার্থ হলো বিশ্বের সবচাইতে মূল্যবান বস্তু।
সার্নের অ্যান্টি ম্যাটার গবেষণা সম্বন্ধে আরো তথ্য পাওয়া যাবে নিচের লিংকে
https://home.cern/science/physics/antimatter
Comments