প্রতি বছর অক্টোবর মাসে সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সাইন্স বিজ্ঞানের তিনটি শাখায় নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে। বিজ্ঞানের এই তিনটি শাখা হলো, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এবং শারীরবিজ্ঞান অথবা মেডিসিন।
বিজ্ঞানের এই তিনটি শাখার যে কোন একটিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে একটি অসাধারণ অর্জন। সারা পৃথিবীতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানীদের অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখা হয়।
কিন্তু দুই দুইবার নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি? ভাবা যায়? এটি হলো একটি বিরল অর্জন। নোবেল পুরস্কারের ১২৩ বছরের ইতিহাসে, এ পর্যন্ত পাঁচজন বিজ্ঞানী দুইবার এই পুরস্কারটি লাভ করার বিরল সম্মান পেয়েছিলেন। এরা হলেন, মেরি কুরি, জন বারডিন, ফ্রেডরিক স্যাঙ্গার, লাইনাস পলিং এবং কার্ল ব্যারি শার্পলেস। এখানে সংক্ষেপে তাঁদের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির বিবরণ দেওয়া হলো:
মেরি কুরি (১৮৬৭-১৯৩৪)
মেরি কুরি জন্মগ্রহণ করেছিলেন পোল্যান্ডে। বিজ্ঞানী মহলে মাদাম কুরি নামেই তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ করতেন তিনি। রেডিয়াম এবং পোলোনিয়াম এই দুইটি মৌলিক পদার্থের আবিষ্কর্তা ছিলেন তিনি। পোলোনিয়ামের নাম করণ করা হয়েছে তাঁর মাতৃভূমি পোল্যান্ডের নামে। মাদাম কুরী দুইবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯০৩ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে প্রথমবার নোবেল পুরস্কার পান। এই পুরস্কারটি মেরি কুরি পেয়েছিলেন তাঁর স্বামী পিয়েরে কুরি এবং ফরাসি বিজ্ঞানী হেনরি ব্যাকারেলের সাথে যৌথভাবে। তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করার জন্য তাঁদের তিনজনকে এই পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছিল। এরপর ১৯১১ সালে দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কারটি তিনি এককভাবে পেয়েছিলেন রসায়নে। এই পুরস্কারটি তাঁকে দেওয়া হয়েছিল রেডিয়াম এবং পোলোনিয়াম এই দুইটি মৌলিক পদার্থের আবিষ্কর্তা হিসেবে। মাদাম কুরি হলেন পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিজ্ঞানের দুইটি ভিন্ন শাখায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর এই রেকর্ড একশ বছরের বেশী সময় ধরে এখনো অক্ষুন্ন রয়েছে। তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে শরীরে তাঁর দুরারোগ্য ব্যাধি বাসা বেঁধেছিলো এবং তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়েছিলো। সারা জীবন তিনি বিজ্ঞানকে ভালোবেসেছিলেন এবং বিজ্ঞানের জন্যই তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
জন বারডিন (১৯০৮-১৯৯১)
মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলী জন বারডিন কাজ করতেন সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে। তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন সময়ে এ নিয়ে প্রথম কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি বেল ল্যাবরেটরীতে যোগদান করে সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে ব্যাপক গবেষনা করেছিলেন। তাঁর এই গবেষণার ফলে ট্রানজিস্টার আবিষ্কৃত হয়। ইলেকট্রনিক্সের ক্ষেত্রে ট্রানজিস্টার একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিল। এই আবিষ্কারের জন্য ১৯৫৬ সালে, জন বারডিনকে যৌথভাবে উইলিয়াম শকলি এবং ওয়াল্টার হাউসারের সাথে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। পরবর্তীতে জন বারডিন সুপার কন্ডাক্টিভিটি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তিনি লিয়ন কুপার এবং রবার্ট স্ক্রিফারের সাথে যৌথ গবেষণা করে বিসিএস সুপার কন্ডাক্টিভিটি থিওরি নামে একটি নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। এজন্য জন বারডিনকে ঐ দুজন বিজ্ঞানীর সাথে ১৯৭২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। জন বারডিনই হলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি পদার্থবিজ্ঞানে দুইবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
ফ্রেডরিক স্যাঙ্গার (১৯১৮-২০১৩)
ব্রিটিশ বায়োকেমিস্ট ফ্রেডরিক স্যাঙ্গার রসায়নে দু'বার নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালে, তিনি এককভাবে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এই পুরস্কারটি তিনি পেয়েছিলেন ইনসুলিনের গঠন আবিষ্কার করার জন্য। তাঁর এই আবিষ্কারের ফলে বাণিজ্যিকভাবে কৃত্রিম ইনসুলিন তৈরি করার পথ সুগম হয়ে যায়। এরপর, ১৯৮০ সালে তিনি দ্বিতীয়বার রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এই পুরস্কারটি তিনি পেয়েছিলেন পল বার্গের সাথে যৌথভাবে। পুরস্কারটি তাঁরা পেয়েছিলেন ডিএনএ সিকোয়েন্সিংয়ের একটি সহজ পদ্ধতি আবিষ্কার করার জন্য। এর ফলে পরবর্তীতে মানব জিনোম সহ অনেক প্রাণী এবং উদ্ভিদের জিনোম সিকোয়েন্স করা সম্ভব হয়েছে। ফ্রেডরিক স্যাঙ্গারকে বলা হয়, ফাদার অফ জিনোমিক্স।
লাইনাস পলিং (১৯০১-১৯৯৪)
মার্কিন রসায়নবিদ লাইনাস পলিং ছিলেন বিংশ শতাব্দীর একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান এবং প্রভাবশালী বিজ্ঞানী। তিনি এককভাবে দুইবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি রসায়নের ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্র প্রয়োগ করে জটিল যৌগিক অণুর গঠন নিয়ে গবেষণা করেছিলেন।হিমোগ্লোবিনের আণবিক গঠন নিয়েও তিনি কাজ করেছিলেন। তাঁর গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৫৬ সালে তাঁকে এককভাবে রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। বিজ্ঞান চর্চার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন সমাজ সচেতন এবং শান্তি প্রিয় মানুষ । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পরমাণু বোমার ভয়াবহতার পর পঞ্চাশের দশকে পরমাণু অস্ত্রের ব্যাপক বিস্তার দেখে তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন। পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধের জন্য তিনি এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিভিন্ন দেশের প্রায় আটহাজার সমমনা বিজ্ঞানীদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তিনি পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা বন্ধে ক্যাম্পেইন শুরু করেন। বিশ্ব শান্তির পক্ষে তাঁর অবদানের জন্য তিনি ১৯৬২ সালে এককভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এর পরের বছরই পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা বন্ধে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে প্রথম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিলো।
কার্ল ব্যারি শার্পলেস (১৯৪১ )
মার্কিন রসায়নবিদ কার্ল ব্যারি শার্পলেশ ২০০১ সালে প্রথমবার রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল কাইরাল কেমিস্ট্রি। ২০২২ সালে তিনি আবারও রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি দ্বিতীয়বার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন
ক্লিক কেমিস্ট্রির ভিত্তি স্থাপনে তাঁর অবদানের জন্য। তাঁর আগে একজন বিজ্ঞানী, রসায়নে দুবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি হলেন, ফ্রেডরিক স্যাঙ্গার, যার কথা আগেই উল্লেখ করেছি।
এখানে বলে রাখি, এই ৫ জন বিজ্ঞানী ছাড়াও, দুটো আন্তর্জাতিক সংস্থা একাধিকবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। আন্তর্জাতিক রেডক্রস তিনবার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে এবং জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত হাইকমিশন ইউএনএইচসিআর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে দুইবার।
© তানভীর হোসেন
Comments