১৯১৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে বলেছিলেন, বস্তুর ভরের কারণে এর চারপাশের স্থান-কালের মাঝে এক ধরনের বক্রতার সৃষ্টি হয়। যে বস্তুর ভর যত বেশি হবে তার চারপাশে স্থান-কালের মধ্যে বক্রতার পরিমাণও হবে তত বেশি। এই বক্রতাকেই আমরা মহাকর্ষ বল হিসেবে দেখি। সপ্তদশ শতাব্দীতে স্যার আইজ্যাক নিউটন মহাকর্ষ বলের যে চিরায়ত ধারণা দিয়েছিলেন তা নিয়ে এর আগে কেউ প্রশ্ন তুলেনি। কিন্তু আইনস্টাইন মহাকর্ষ নিয়ে একটি সম্পূর্ণ নতুন কথা শোনালেন। তাঁর মতে মহাকর্ষ মূলত স্থান-কালের চাদরে বক্রতারই বহিঃপ্রকাশ। এটা একটি জ্যামিতিক ব্যাপার। বলাই বাহুল্য, আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্বটি ছিল একেবারেই যুগান্তকারী এবং চাঞ্চল্যকর।
কিন্তু বিজ্ঞানে শুধু তত্ত্ব দিলেই চলবে না। তত্ত্ব প্রমাণ করা চাই। আর এই কাজটাই করেছিলেন ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্যার আর্থার এডিংটন। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশিত হওয়ার চার বছর পর, ১৯১৯ সালের ২৯ মে একটি পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। সেদিনের পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সুবর্ণ সুযোগটিকেই তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন।
এই পরীক্ষার জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন সূর্যের কৌণিক অবস্থানের কাছাকাছি থাকা একটি নক্ষত্রকে। পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময়, আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল এবং ব্রাজিলের একটি অঞ্চল থেকে যুগপৎভাবে নক্ষত্রটির ছবি তোলা হলো। দিনের বেলায় সূর্যের অবস্থানের জন্য এই নক্ষত্রটিকে দেখা সম্ভব ছিল না। কিন্তু সূর্যগ্রহণের সময় নক্ষত্রটি দৃশ্যমান হয়ে উঠলো। নক্ষত্রটির আলোকরশ্মি বিশ্লেষণ করে দেখা গেল নক্ষত্রটি তার স্বাভাবিক অবস্থান থেকে ১.৭৫ আর্ক সেকেন্ড সরে এসেছে। আর্থার এডিংটন বুঝতে পারলেন, সূর্যের ভরের কারণে তার চারপাশের স্থান-কাল কিছুটা বাঁকা হয়ে গেছে। তার ফলে ওই বাঁকা পথ অতিক্রম করতে গিয়ে নক্ষত্রটির আলোও কিছুটা সরে গিয়েছে। তিনি হিসেব করে দেখলেন, নক্ষত্রের আলোর এই বক্রতার পরিমাণ আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের হিসেবের সাথে মিলে যাচ্ছে। এটা ছিল আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের স্বপক্ষে প্রথম পরীক্ষামূলক প্রমাণ। এই সফল পরীক্ষার ফলে আইনস্টাইন রাতারাতি হয়ে উঠলেন বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা বিজ্ঞানী। এরপর অবশ্য আরো নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নির্ভুল ভাবে প্রমানিত হয়েছে।
পরবর্তীতে স্থান-কালের বক্রতার উপর নির্ভর করে "গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং" নামে জ্যোতির্বিজ্ঞানে একটি বিশেষ পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। ম্যাগনিফাইং গ্লাসের লেন্সের মত গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সও ক্ষীণ আলোকরশ্মিকে বর্ধিত করে তোলে। এই আলোকরশ্মিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এখন তাদের পর্যবেক্ষণের কাজে লাগাচ্ছেন।
মনে করুন, একটি বিশাল গ্যালাক্টিক ক্লাস্টারের ঠিক পেছনে ছোট একটি দূরবর্তী গ্যালাক্সি রয়েছে। তখন ছোট গ্যালাক্সির ক্ষীণ আলোকরশ্মি সামনের বিশাল গ্যালাক্টিক ক্লাস্টারের প্রবল মহাকর্ষ বলের প্রভাবে দুদিকে বেঁকে আমাদের চোখে দৃশ্যমান হবে। এই বক্রতার ফলে দূরবর্তী গ্যালাক্সিটির ক্ষীণ আলো দ্বিগুণ বর্ধিত হয়ে দুটো গ্যালাক্সি হিসেবে দেখা যাবে। এভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দূরবর্তী অনেক ক্ষীণ গ্যালাক্সিকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। মজার ব্যাপার হলো, অনেক সময় অত্যন্ত শক্তিশালী গ্রাভিটেশনাল লেন্সিংয়ের ফলে দূরবর্তী অনেক গ্যালাক্সিকে রিংয়ের আকৃতিতে দেখা যায়। আইনস্টাইনের সম্মানে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এদের নাম দিয়েছেন, "আইনস্টাইন রিং"।
হাবল স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং পদ্ধতিতে বেশ কিছু আইনস্টাইন রিং এর সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ আইনস্টাইন রিং হলো , GAL-CLUS-022058s (ছবি দেখুন)।
ইদানিংকালে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপে একই পদ্ধতি ব্যবহার করে দূরবর্তী গ্যালাক্সির ছবি তোলা হচ্ছে।
মোদ্দা কথা, গ্রাভিটেশনাল লেন্স হলো এক ধরনের প্রাকৃতিক ম্যাগনিফাইং লেন্স যার প্রবল মহাকর্ষ বলের সাহায্যে জ্যোতির্বিদরা অত্যন্ত ক্ষীণ এবং দূরবর্তী অনেক গ্যালাক্সির সন্ধান পেয়েছেন।
এখানে অবশ্য ধন্যবাদ দিতে হয়, বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে যার সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং পদ্ধতিটি আবিষ্কার করা হয়েছে।
বর্তমানে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে মহাবিশ্বের গঠন, বিস্তার এবং বিশেষত ডার্ক ম্যাটার সম্বন্ধে বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা অনেক নতুন তথ্য জানতে পেরেছেন।
Comments