প্রফেসর আনন্দমোহন চক্রবর্তী (১৯৩৮-২০২০)

বাঙালি বিজ্ঞানী আনন্দমোহন চক্রবর্তীর জন্ম হয়েছিল ১৯৩৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের সাঁথিয়ায়। তিনি পড়াশোনা করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর বিষয় ছিল মাইক্রোবায়োলজি, বাংলায় যাকে বলে অণুজীববিজ্ঞান।১৯৬৫ সালে কলকাতায় পড়াশোনার পাট চুকিয়ে তিনি উচ্চশিক্ষার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। পরবর্তীতে তাঁর পিএইচডি এবং গবেষণা সবই করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। 

তিনি ছিলেন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গবেষণার ক্ষেত্রে একজন পথিকৃৎ। সত্তরের দশকের শুরুতে তিনি চার ধরনের সিউডোমোনাস (Pseudomonas) ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা শুরু করছিলেন। এসব ব্যাকটেরিয়াগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো এরা পেট্রোলিয়ামের হাইড্রোকার্বনকে ভেঙে দিতে পারে। জাহাজ থেকে জ্বালানি তেল চুঁইয়ে সমুদ্রের পানি দূষিত হওয়া একটি মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যা। সেজন্য এসব প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে সমুদ্রের তৈলদূষিত পানিকে কিভাবে পরিশোধন করা যায় সে নিয়ে তখন গবেষণা চলছিলো। 

সেই সময় ডক্টর চক্রবর্তী গবেষণার কাজ করতেন একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে। তিনি ব্যাকটেরিয়াগুলোর মধ্যে চারটি ভিন্ন ধরনের প্লাসমিডের (plasmid) সন্ধান পেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন এই প্লাসমিডগুলোর ভেতরেই পেট্রোলিয়ামের হাইড্রোকার্বন ভাঙ্গার জেনেটিক কোড নিহিত রয়েছে। এই চারটি প্লাসমিডের ভেতরে জেনেটিক ক্রস লিঙ্কিং করে তিনি একটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করতে সক্ষম হলেন। যেটি প্রকৃতিতে আর কখনোই দেখা যায়নি। পেট্রোলিয়ামের হাইড্রোকার্বনকে ভাঙ্গার ব্যাপারে এই নতুন ধরনের ব্যাকটেরিয়াটি প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়াগুলোর চেয়ে অনেক বেশী কার্যকরী বলে প্রমাণিত হলো। প্রফেসর চক্রবর্তী উদ্ভাবিত এই নতুন ধরণের ব্যাকটেরিয়াটি Pseudomonas putida প্রজাতির অন্তর্গত। এই নুতন তৈলবিনাশী ব্যাকটেরিয়াটির বাণিজ্যিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট (patent) অফিসে এর পেটেন্টের জন্য আবেদন করা হলো। 

পেটেন্ট হলো নতুন আবিষ্কারের জন্য এক ধরনের মেধাস্বত্ব। এর মাধ্যমে নতুন কোন আবিষ্কারের উপর আবিষ্কর্তার বাণিজ্যিক অধিকার সৃষ্টি হয়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট অফিস তাঁর পেটেন্টের আবেদন প্রত্যাখ্যান করলো। তাদের যুক্তি হলো নুতন ব্যাকটেরিয়াটি একটি জীবিত বস্তু, সেজন্য এটির উপর কারো পেটেন্ট অধিকার থাকতে পারে না। ডক্টর চক্রবর্তী তখন আইনের শরণাপন্ন হলেন। 

যারা পেটেন্ট নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা "ডায়মন্ড ভার্সেস চক্রবর্তী" এই কোর্ট কেইসটির সাথে পরিচিত। সেই সময় সিডনি ডায়মন্ড ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমিশনার অফ পেটেন্ট। পেটেন্ট অফিসের কমিশনারের বিরুদ্ধে ডক্টর চক্রবর্তী তাঁর আবিষ্কৃত ব্যাকটেরিয়া নিয়ে দীর্ঘ আইনি লড়াই লড়েছিলেন। 

এই মামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ডক্টর চক্রবর্তীর পক্ষেই রায় দিয়েছিলো। কোর্টের সিদ্ধান্ত ছিলো, আবিষ্কৃত বস্তুটি জীবিত না জড়, এটি পেটেন্ট পরীক্ষার বিষয় নয়। আবিষ্কারটি একটি সম্পূর্ণ নতুন উদ্ভাবন কিনা এবং এটি একটি উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে কিনা সেটাই হবে পেটেন্ট পরীক্ষার বিবেচ্য বিষয়। তাঁর আবিষ্কৃত ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে এই দুটি নিয়ামকই প্রযোজ্য ছিলো। অতএব এখানে পেটেন্ট প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো বাঁধা রইলো না। এটি ছিল পেটেন্টের জগতে একটি ল্যান্ডমার্ক কেস যেটি বায়োলজিক্যাল রিসার্চের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলো। ‌এর ফলে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে অনেক নতুন আবিষ্কার এবং এসব ক্ষেত্রে মেধাস্বত্বের অধিকারের পথও সুগম হয়ে গিয়েছিলো। 

প্রফেসর চক্রবর্তী পরবর্তী জীবনে শিকাগোর ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়ের কলেজ অব মেডিসিনের একজন ডিস্টিঙ্গুইশড প্রফেসর ছিলেন। এখানে থাকাকালীন সময়ে তিনি ক্যান্সার নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন। কিন্তু এই বাঙালি বিজ্ঞানী বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর আবিষ্কৃত সেই তৈলবিনাশী ব্যাকটেরিয়াটির জন্য, যার মাধ্যমে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গবেষণায় একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছিলো। অনুজীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ২০২০ সালে এই প্রথিতযশা বিজ্ঞানী‌ পরলোকে গমন করেন। ‌তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

Comments